Advertisement
E-Paper

তুমি আসবা কিন্তু, অপেক্ষায় থাকুম মামা

মাঝের রেল লাইন বরাবর কাঁটাতার না থাকলেও নিষেধ রয়েছে রাষ্ট্রের। তাই, তা টপকে নদিয়ার মাটিতে পা রাখতে পারেনি মামুদ রশিদের আব্বা, রাজশাহীর চামটা গ্রামের বছর সত্তরের আব্দুল করিম। দু’বছর পরে এ দেশের সীমানা আর লালা ফিতের ফাঁস কেটে মামুদ যখন তাঁর আব্বাকে জড়িয়ে ধরল, তখন চোখের জলে ‘এ পার-ও পার স্মৃতিময় একাকার’।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৪৪
মোসলেম ও মামুদ। নিজস্ব চিত্র

মোসলেম ও মামুদ। নিজস্ব চিত্র

দু’পার ভাগ করা কাঁটাতারের বেড়াটা যে মাঝে রয়েছে, সে খেয়াল ছিল না যুবকটির। খেয়াল থাকবেই কী করে? ওপারে দাঁড়িয়ে যে মানুষটা হাত নাড়ছেন, তিনি যে তাঁর আব্বা।

মাঝের রেল লাইন বরাবর কাঁটাতার না থাকলেও নিষেধ রয়েছে রাষ্ট্রের। তাই, তা টপকে নদিয়ার মাটিতে পা রাখতে পারেনি মামুদ রশিদের আব্বা, রাজশাহীর চামটা গ্রামের বছর সত্তরের আব্দুল করিম। দু’বছর পরে এ দেশের সীমানা আর লালা ফিতের ফাঁস কেটে মামুদ যখন তাঁর আব্বাকে জড়িয়ে ধরল, তখন চোখের জলে ‘এ পার-ও পার স্মৃতিময় একাকার’।

আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতই ছেলে-বউ নিয়ে সংসার করত চামটার মামুদ রসিদ। মাঠে লাঙল দেওয়া আর আর ক্লান্ত দুপুরে গাছের ছায়ায় দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া। ভালই চলছিল জীবন। হঠাৎ যে কি হল! ছেলেটাকে নাকি ‘জিন’-এ ধরল। রোগ তার একটাই, এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে বেড়ানো। সেই ঘুরতে ঘুরতে এক দিন আর বাড়িতে ফিরল না সে।

পরিবারের লোকেরা তাঁকে খুঁজতে কসুর করেনি। কিন্তু পাওয়া গেল না বছর পঁয়ত্রিশের মামুদকে। এ দিকে পথ ভুলে মামুদ চলে আসে চাপড়ার সীমান্তে। আপন খেয়ালে কাঁটাতারের ফাঁক গলে ভারতের মাটিতে। কিন্তু বিএসএফ জওয়ানদের কাছে পাগলের কোন ছাড় নেই। পাগলের বেশে অন্য কেউ নয় তো? নিয়ে আসা হল ক্যাম্পে। জেরা করে জানার চেষ্টা হল, কী তাঁর উদ্দেশ্য।

শেষপর্যন্ত মানসিক ভারসাম্যহীন নিশ্চিত হওয়ার পর তুলে দেওয়া হল চাপড়া থানার পুলিশের হাতে। সেখান থেকে মহকুমা শাসকের নির্দেশে ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর নাকাশিপাড়ার ‘নির্মল হৃদয়’ হোমে। ডান পায়ের হাড় তখন ভাঙা। বেশ কয়েক মাস চিকিৎসার পরে সুস্থ হল মামুদ। মনে পড়ে গেল গাছগাছালি ভরা তাঁর গাঁয়ের কথা। তাঁর মা-বাবা, স্ত্রী টিয়া, ছেলে বছর বারোর ইনসানের জন্য মন কেমন করা শুরু হল। হোম থেকে চিঠি গেল তাঁর বাড়ির ঠিকানায়। উত্তর আসতে সময় লাগেনি। বছর দেড়েক আগে ভাগ্নেকে নিয়ে যেতে এলেন মামা নুরুল ইসলাম। কিন্তু অনুমতি মিলল না। সেই আইন-কানুনের প্যাঁচ। আন্তর্জাতিক বিষয়। সরকারি কর্তারা জানিয়ে দিলেন, “রসো একটু। অত্ত সহজ নাকি। হুঁ হুঁ বাবা, আন্তর্জাতিক বিষয় বলে কথা।” প্রশাসনের দরজায় ঘুরে ঘুরে কোনও লাভ হয়নি। সকলেই জানিয়ে দিয়েছেন বিষয়টা দুই দেশের। তাই ফিরে যাওয়ার পদ্ধতিটাও জটিল হল। সময় এগোতে থাকল নিজের মতো। অবশেষে দেশে ফিরে যান মামা। কিন্তু হোম কর্তৃপক্ষ থেমে থাকেননি। মহকুমা ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে রাজ্য সরকার হয়ে সেই আবেদন পৌঁছল কেন্দ্র সরকারের কাছে। শেষ পর্যন্ত দুই দেশের অনুমতির ভিত্তিতে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সুযোগ আসে। স্বরাষ্ট মন্ত্রক থেকে মেলে অনুমতিও। সেই মত নাকাশিপাড়ার হোম কর্তৃপক্ষ আবার যোগাযোগ করে মামুদের পরিবারের সঙ্গে। ঠিক হয় রবিবার গেদে সীমান্ত দিয়েই মামুদকে তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

এত দিন হোমে থেকে বাড়ির বাচ্চাদের চাচা আর পাড়ার মাচার সদস্য হয়ে ওঠে মামুদ। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের কর্তারা হোম পরিদর্শনে গেলে তাদের কাছে কেঁদে পড়েছিল মামুদ, “কত্তা, আমারে পরিবারের কাছে ফেরায় দ্যান।”

হোমের কর্নধার মোসলেম মুন্সিকে সে মামা ডেকেছিল। মাঝেমধ্যেই তাঁকে বলতেন, “মামা, ছেলে-বউয়ের জন্যি পরাণ যে বড় কান্দে।” এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে আসে চিঠি। খুলে যায় বাড়ির দরজা। জেলা শাসক সুমিত গুপ্ত বলেন, “দুই দেশের সহমতের ভিত্তিতেই ওই যুবক বাড়ি ফিরতে পারলেন।” রবিবার ভোরেই স্নান সেরে পাটভাঙা জামা পরে তৈরি হয়ে নেন মামুদ। তর যে সয় না আর। তবে মনটা ভারও হয়ে আসে। এত দিন এক সঙ্গে থাকা মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হয় তাঁর। বাবাকে হাতের কাছে পেয়েই তাই নিজেকে ধরে রাখতে পানে না মামুদ। ফেরার পথে মোসলেমকে বলে যান, “তুমি আসবা কিন্তু আমার বাড়িতে। আমি অপেক্ষায় থাকুম মামা।”

India Bangladesh Border
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy