কাজের ফাঁকে বইয়ে চোখ কল্পনা পালের। হোগলবেড়িয়ার আরবপুরের বাড়িতে। — নিজস্ব চিত্র
প্রতিদিনের রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, সংসার অন্যান্য কাজ সেরে মাটির কাজ নিয়ে বসেন তিনি। মাটির আম-কাঁঠাল-পুতুল আরও কত কী... স্বামীর হাতে হাতে তৈরি করে দেন। আর এ সবের মাঝেই ঠিক সময় বের করে বসে পড়েন ‘সহজ পাঠ’ নিয়ে। এই ছাপান্ন বছর বয়সে।
তিনি হোগলবেড়িয়ার আরবপুরের বাসিন্দা কল্পনা পাল। জানালেন, আর পাঁচটা শিশুর মতো তাঁর মেয়েবেলাটা তেমন সহজ ছিল না। গরিবের সংসারে শৈশবের পাঠ তাই মেলেনি। কিন্তু তাঁর অদম্য ইচ্ছেকে রোখে কে! তাই এ বয়সে, ছেলেমেয়েরা যখন বড় হয়ে গিয়েছে, সংসারের ভাড় কিছুটা কমেছে, নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছেন কল্পনাদেবী। পাশে পেয়েছেন বাড়ির সকলকেই। বিশেষ করে স্বামী মৃৎশিল্পী সমর পালকে।
কী হয়েছিল ছোটবেলায়? কেনই বা এত সাধের পড়াশোনাটা হল না?
সে কাহিনি জানালেন প্রৌঢ়া নিজেই। বললেন, “মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতে আমার বাপের বাড়ি। মাত্র আড়াই বছর বয়সে বাবাকে হারাই। তিন ভাই ও তিন বোন। সকলকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন মা।’’ কল্পনাদেবী জানালেন, অভাবের সংসারে ছয় ভাইবোনের মুখে রোজ দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেতেন তাঁর মা। লোকের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান ভেঙে এসে বাড়িতে এক কড়াই শাক সেদ্ধ করে দিতেন তাদের। তখন পেট ভরানোটাই ছিল সবার চিন্তা। পড়াশোনার কথা কেউ ভাবতেই পারেননি কেই।
‘‘তবুও মা খুব চাইতেন আমরা পড়াশোনা করি। কিন্তু কোনও উপায় ছিল না। মাকে সংসারের ভার থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে বছর বারোর বড় দাদা মিষ্টির দোকানে কাজ নেন। দিদিরা এক এক জনের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। আমাকেও পাঠিয়ে দেয় উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরের একটি বাড়িতে।’’ পাঁচ বছর বয়স থেকে সেখানেই জীবন শুরু কল্পনাদেবী। সেই বাড়িতে থেকে খেয়ে ফাই ফরমাস খেটে রোজগার।
এর পর উনিশ বছর বয়সে বিয়ে। চলে এলেন শ্বশুর বাড়িতে। সেখানেও চরম অভাব। স্বামীর সঙ্গে মাটির কাজের পাশাপাশি পরিবারের হাল টানতে হতো। কিন্তু সে আয়ে সংসার চালানো কঠিন ছিল। তাই শুরু করেন বিড়ি বাঁধার কাজ।
নিজেরা না পারলেও, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে কিন্তু খুব কষ্টে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। আজ বড় ছেলে সুব্রত এমএ পাশ করে স্কুলে শিক্ষকতা করছে। বিএ পাশ করা একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট ছেলে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস-এর ছাত্র। কিন্তু নিজের মনে একটা খেদ থেকে গিয়েছিলই।
সে ক্ষতটা সারিয়ে দিল পাঁচ বছরের নাতি। খুদের সঙ্গেই গত এক বছরের চেষ্টায় নতুন করে শিখেছেন, অ, আ, ই, ঈ। দিনের বেলায় সারাদিন কাজ থাকে। তাই কখনও ভোরে উঠে, কখনও বা রান্নাবান্না ও মাটির কাজের ফাঁকে পড়াশোনা করেন তিনি। এখন যুক্তাক্ষর পড়তে অসুবিধা হলেও টুকটাক সবই পড়তে পারেন।
কল্পনা দেবীর স্বামী সমর পাল বললেন, “বিয়ের আগে, পরে সংসারের চাপে আমার স্ত্রী স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু ওর পড়ার ইচ্ছেটা ছিল বরাবরই। নিজের সব শখ-আহ্লাদ ছেড়ে সারা জীবন আমার সংসার ঠেলে গিয়েছে। বছর খানেক আগে ছেলেরা বর্ণপরিচয় এনে দেয় মাকে। সেই শুরু।’’
কিছু দিন আগেই শান্তিনিকেতন থেকে নিজে হাতে সহজ পাঠের তৃতীয় ভাগ কিনে এনেছেন কল্পনা দেবী। ছোট ছোট বই, পুজোর পাঁচালি ছাড়াও রোজ খবরের কাগজ পড়েন। ‘‘ওঁর এই তাগিদকে আমি সম্মান জানাই। যতটা সম্ভব উৎসাহ দিই,” বললেন সমরবাবু।
কল্পনা দেবীর ছোট ছেলে দেবব্রতর কথায়, “মা বরাবরই সংস্কৃতিমনা। কোথাও নাটক বা কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে শুনলেই ছুটে যান। রেডিও-র নাটকেও মায়ের খুব ঝোঁক। দাদা-আমি বাবা মায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে বই কিনে আনি। শাড়ি বা গয়নার থেকে বই পেলেই মা বেশি খুশি। এতদিন মা আমাদের ইচ্ছে পূরণ করেছেন। এখন মায়ের স্বপ্ন পূরনেই আমাদের আনন্দ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy