Advertisement
E-Paper

‘রোডসাহেব’ নেই, উধাও হচ্ছে গাছ

রাস্তা সম্প্রসারণের কাজের জন্য সম্প্রতি কুলি থেকে গোকর্ণ পর্যন্ত রাজ্য সড়কের দু’ধারে থাকা গাছগুলিতে কোপ পড়েছে। তা নিয়ে সরগরম সমাজ-মাধ্যম। ফুঁসছেন এলাকার লোকজনও। 

শুভাশিস সৈয়দ

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৯ ০৫:১৬
কান্দি-বহরমপুর রাজ্য সড়কে এ ভাবেই কমছে গাছ। খোশবাসপুরে। নিজস্ব চিত্র

কান্দি-বহরমপুর রাজ্য সড়কে এ ভাবেই কমছে গাছ। খোশবাসপুরে। নিজস্ব চিত্র

‘‘কত গাছ মারা যাবে। রাস্তাটা জায়গায় জায়গায় ন্যাড়া হয়ে যাবে। ভাবতে বুক কাঁপছে। কোন মুখে দাঁড়াব গাছগুলোর সামনে? রাস্তা সোজা করার পর টেন্ডার ডেকে বাড়তি গাছগুলোকে নীলাম করে দেবে ব্যাটারা। কন্ট্রাক্টর তো মুখিয়ে আছে! করাত কুড়ুল নিয়ে দৌড়ে আসবে। কী ভয়ঙ্কর ঘটনা না ঘটবে! একে তো আজকাল একটা গাছের চারা বাঁচানো যায় না!’’— প্রায় ৭০ বছর আগে লেখা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘রোডসাহেব’ উপন্যাসে ঠিক এমনটাই বর্ণনা রয়েছে।

রাস্তা সম্প্রসারণের কাজের জন্য সম্প্রতি কুলি থেকে গোকর্ণ পর্যন্ত রাজ্য সড়কের দু’ধারে থাকা গাছগুলিতে কোপ পড়েছে। তা নিয়ে সরগরম সমাজ-মাধ্যম। ফুঁসছেন এলাকার লোকজনও।

কয়েক বছর আগে যশোর রোডে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজের জন্য রাস্তার দু’ধারের গাছ কাটা নিয়ে জনস্বার্থে মামলা হয়েছিল। সেই সময়ে কলকাতা হাইকোর্ট ওই গাছ কাটার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরে বন্ধ হয়। তত দিনে অবশ্য বেশ কিছু গাছের মৃত্যু পরোয়ানা লেখা হয়ে গিয়েছিল। তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়নি। কিন্তু বাকি গাছগুলি বেঁচে গিয়েছিল!

এ ক্ষেত্রে অবশ্য তেমনটা ঘটেনি। ফলে একের পর এক গাছে কোপ পড়ছে এবং মাটির তলা খুঁড়ে মোটা গুঁড়ি-সহ উপড়ে ফেলা হচ্ছে।

‘রোডসাহেব’ উপন্যাসেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখছেন, ‘‘গাছ লাগানো নাকি ইংরেজ রেসিডেন্ট আমল থেকে। বিশ্বাস করিনি। তার আগে কী এদেশের রাস্তা ন্যাড়া হয়ে রোদজলে পড়ে পড়ে বেদম মার খেত? হিসট্রি খুলে দেখ না বাবা! সম্রাট অশোক কী করেছিলেন? রাস্তা থাকবে, তার ধারে গাছ থাকবে না—এটা দেশের গল্প হল! ...রাস্তাটা ছিল। এখনও আছে। মান্ধাতার আমল থেকে ছায়ার পোশাকে তার আব্রু ঢাকতে গাছ-গাছালি লাগানো হয়েছে।’’

রোডসাহেব উপন্যাসের নায়ক কালীনাথ বসু ‘রোডসাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ‘রোডসের সুপারভাইজার ছিলেন।’ পরনে থাকত ‘খাকি হাফপ্যান্ট আর সাদা হাফশার্ট, পায়ে মোজা ও কেডস জুতো, বগলবাদা শোলার হ্যাট।’ বহরমপুর-কান্দি রাজ্য সড়কের দু’ধারে ছোট বড় মিলিয়ে ছিল ‘পাঁচ হাজার নশো বেয়াল্লিশটা গাছ।’

খোশবাসপুরের প্রবীণ আনোয়ান আলম বলছেন, ‘‘ওই পথের দু’ধারে শিরিষ, বট, অর্জুন, মেহগনি, শিশুগাছ ছিল। সাইকেল রেখে ওই ছায়াঘেরা বিশাল গাছের নীচে বসে বিশ্রাম নিতে দেখেছি পথচারীদের। খরার সময়ে আমরাও গ্রামের তেমাথার মোড়ে গাছের নীচে গিয়ে বসতাম। একের পর এক সেই সব গাছ কেটে ফেলা হল।’’

গাছ কাটার ছবি পোস্ট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন এলাকার যুবকেরা। সেখানে রানিনগরের গোধনপাড়ার বাসিন্দা পেশায় হকার আসাদুল শেখ লিখেছেন—‘বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ছোলা-ডাল বেচে দুপুরের দিকে ফেরার পথে রণগ্রাম-গোকর্ণের রাস্তায় যে বট গাছের তলায় বসে শান্তি পেতাম, সেই গাছটা কেটে ফেলেছে। ওই গাছটার কাছে এলে মন খারাপ হয়ে যায়।’ ‘ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে কাটা গাছগুলো দেখে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠছিলো বলে জানান নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রাবণী বন্দ্যোপাধ্যায় আবার প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘সেই কাটা গাছ কি ফিরিয়ে দেবে সরকার?’’

সে সব পড়ে আলাম শেখ লিখেছেন, ‘গোকর্ণ থেকে কুলি পর্যন্ত রাজ্য সড়ক চওড়া করতে গাছ কাটা হয়েছে। সেখানে নতুন করে গাছ লাগানো হবে।’ তার পাল্টা এক জন লিখেছেন— নতুন গাছ লাগালে সেই বাস্তুতন্ত্র ফিরে আসবে? আড়াই-শো-তিনশো বছরের পুরনো গাছ কাটার ফলে যে পরিমাণ বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হবে, সেটা ফিরে আসতে কত সময় লাগবে, সেটা একবার হিসেব করে দেখেছেন?’

রোডসাহেব কান্দি-বহরমপুর রাজ্য সড়ক লাগোয়া এলাকায় ‘রাস্তার দুধারে যত গাঁ আছে, সব গাঁয়ের কিছু না কিছু লোকের মনে নিজের মমতাটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।’

এখন সেই ‘রোডসাহেব’-এর অভাব বোধ করছেন এলাকার মানুষ!

Tree Environment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy