Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

টানা বৃষ্টিতে ক্ষতির মুখে সব্জি চাষ

অনাবৃষ্টির শুখা মাঠ অতিবৃষ্টিতে থই থই করছে এখন। দেখলে মনে হয় মাঠ তো নয়, যেন অকুল পাথার। দিগন্তে মেশা ওই পাথারে ফসলহানির আশঙ্কায় চাষির কপালে ভাঁজ ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের অনেক আগেই এ বার মেঘদূত হাজির হয়েছিল রাজ্যে। গোটা বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ জুড়ে তীব্র গরম আর টানা অনাবৃষ্টির জেরে শুকিয়ে মরতে বসেছিল পাট।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৫ ০১:০৭
Share: Save:

অনাবৃষ্টির শুখা মাঠ অতিবৃষ্টিতে থই থই করছে এখন। দেখলে মনে হয় মাঠ তো নয়, যেন অকুল পাথার। দিগন্তে মেশা ওই পাথারে ফসলহানির আশঙ্কায় চাষির কপালে ভাঁজ ক্রমশ চওড়া হচ্ছে।

আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের অনেক আগেই এ বার মেঘদূত হাজির হয়েছিল রাজ্যে। গোটা বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ জুড়ে তীব্র গরম আর টানা অনাবৃষ্টির জেরে শুকিয়ে মরতে বসেছিল পাট। রাজ্যের প্রধান অর্থকরী ফসলের বেহাল দশা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন পাটচাষিরা। খারিফ মরসুম পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কাঁটা হয়েছিলেন সকলে।

সম্প্রতি বৃষ্টির হাত ধরে সে যাত্রায় স্বস্তি মিলেছে। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে নির্ধারিত সময়ের কমবেশি দেড় মাস পরে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তারিখটা ছিল ১১ জুন। তারপর থেকে মাঝে দু’একদিন বাদ দিলে প্রায় রোজ অল্পবিস্তর বৃষ্টি হচ্ছে। শেষ সপ্তাহ জুড়ে আকাশ সর্বক্ষণ কালো মেঘে ঢাকা। চলছে দফায় দফায় বৃষ্টি। কখনও ঝিরিঝিরি, কখনও রাতভর মুষলধারে। প্রাকবর্ষার বৃষ্টিপাতের সঙ্গে হালকা নিম্নচাপের যুগলবন্দির মাঝে, মূল বর্ষাও যে কবে কখন ঢুকে পড়ল তা যেন ঠাহর করা গেল না এ বার।

বৃষ্টি নিয়ে ডামাডোলের নিট ফল, জুন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে যা ভাল লক্ষণ নয়। আমন থেকে শাকসব্জি— সব কিছুই এই বৃষ্টিপাতের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই তাঁদের আশঙ্কা। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্যবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান আফতাব জামান বলেন, “এখন যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। ইতিমধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে গত ক’দিনে। তার ফলে পাট ছাড়া সব ধরনের ফসলের ক্ষতি হবে। বিশেষ করে শাকসব্জির ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্ট বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

বর্তমানে ক্ষুদ্রসেচ নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের একটি প্রকল্পের জেলা কো-অর্ডিনেটর আফতাব জামানের মত, এককালীন বৃষ্টির একাধিক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। মরসুমের শুরতেই অতিরিক্ত বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে দীর্ঘকালীন অনাবৃষ্টির সঙ্কেত দেয়। বর্ষার ভরা মরসুমে যে অনাবৃষ্টির কারণে কৃষকের আরও বড় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে। তা ছাড়া এক সঙ্গে প্রচুর বৃষ্টি হলে বেশির ভাগ জলের অপচয় হয়। সে জলে না ভূগর্ভস্থ জলস্তর পূর্ণ হয়, না হয় চাষের উপকার। বেশির ভাগ জলে গড়িয়ে যায় নিকাশি পথ বেয়ে!

জুনের প্রথম অর্ধে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টির হিসাব স্পষ্ট হয়ে যায় জেলা কৃষি দফতরে নথিভুক্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণের দিকে তাকালে। ২৭ জুন নদিয়ায় বৃষ্টি হয়েছিল ৯৫ মিলিমিটার, ২৬ জুন ৩৬ মিলিমিটার, ২৫ জুন ২৩ মিলিমিটার, ২৪ জুন ১৩৪ মিলিমিটার, ২৩ জুন ৯১ মিলিমিটার। নদিয়া সংলগ্ন বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে গত দু’দিনে ২৭ জুন ১৪৫ মিলিমিটার এবং ২৮ জুন ৪৯.২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

বর্ধমানের সহ কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ জানান, যে বৃষ্টিকে শুরুতে আসন্ন খারিফ মরসুম এবং পাটের জন্য ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছিল এখন ঠিক তার উল্টো হয়ে গেল। তিনি বলেন, “আমনের বীজতলার জন্য সঠিক সময় এখন। চাষিরা বীজতলা তৈরিও করে ফেলেছেন। কিন্তু অতিবৃষ্টির ফলে অধিকাংশ চাষির বীজতলা ধুয়ে গিয়েছে। প্রথমে বৃষ্টি না আসায় আমনের বীজতলার কাজ সঠিক সময়ে শুরু করা সম্ভব হবে বলে মনে হলেও এখন বেশি বৃষ্টির জন্য খরিফ মরশুমে সেই বিঘ্ন ঘটল।”

এই বৃষ্টিতে সবচেয়ে ক্ষতি হবে ফসলের। এমনই মত কৃষি বিশেষজ্ঞদের। নদিয়ার জেলার সহ কৃষি অধিকর্তা মনোরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, “এই সময়ে বৃষ্টি হলেও এতটা হয় না। ফলে চাষের কিছুটা ক্ষতি তো হবেই। বিশেষ করে সব্জির ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। তবে পাটের ক্ষেত্রে এই বৃষ্টি ভাল।” প্রাক্তন কৃষি আধিকারিক নিশীথকুমার দে মনে করেন, আমনের বীজতলার ক্ষতি হবে। তবে পাটের খুব উপকার হবে। তবে পাটচাষিরা জানাচ্ছেন, প্রবল বৃষ্টিতে পাটগাছের মাথা কেটে গিয়েছে। তাতে গাছের বাড় ব্যহত হবে। অন্য দিকে, মাচা এবং ভুঁই সব ধরনের সব্জি যেমন পটল, ঝিঙে, শশা, ঢেঁড়স, কুমড়োর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিশীথবাবুর মত, “এখন দরকার টানা কড়া রোদ। যাতে জমির মাটি শুকিয়ে যেতে পারে। জমা জল সবার আগে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জমিতে মেটালাক্সিন ৮ শতাংশ এবং ম্যাঙ্কোজেব ৬৪ শতাংশ প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম মিশিয়ে দিতে হবে। অথবা কপারঅক্সি ক্লোরাইড বা কারবেন্ডিজিমও ব্যবহার করা যেতে পারে।”

কৃষি কর্তা পার্থ ঘোষ মনে করেন, এই বৃষ্টি সব্জির উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। মাঠের সব্জি তো চরম ক্ষতিগ্রস্ত হলই। পাশাপাশি কপির মতো যে সব জলদি জাতের সব্জি এখন বোনা হয় এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ বাজারে আসে, সে সব সব্জি চাষ পিছিয়ে গেল! সব মিলিয়ে আগামী এক মাস বাজারে সব্জির আকাল হতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। এই বৃষ্টির সুবিধে কী? কৃষিকর্তারা জানাচ্ছেন, সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে চারপাশে শুকিয়ে যাওয়া পুকুর, ডোবা বা নয়ানজুলি গুলি জলে ভরে গিয়েছে। পাট পচানো নিয়ে এ বার আর সমস্যা থাকবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debashis bandopadhyay rain vegetable jute
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE