Advertisement
১৯ মে ২০২৪
ভয়ের ভাসান যাত্রা

চোখ রাঙালেও হাত উঠল না গায়ে

কার্তিক মাস। বিকেল বিকেলই আলো ঢেকেছে আঁধারে। তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। কৃষ্ণনগরের শীর্ণ রাস্তায় দেওয়াল লেপ্টে দাঁড়িয়ে মানুষ— ‘ওই ঠাকুরটা দেখ কেমন দুলছে...এই রে পাল পাড়ারটাও বেরিয়ে পড়ল যে, একই সঙ্গে এ বার!’’

বিসর্জনের রাতে ভিড়ে ঠাসা কৃষ্ণনগরের হাই স্ট্রিট। — ফাইল চিত্র

বিসর্জনের রাতে ভিড়ে ঠাসা কৃষ্ণনগরের হাই স্ট্রিট। — ফাইল চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০১:১৪
Share: Save:

কার্তিক মাস। বিকেল বিকেলই আলো ঢেকেছে আঁধারে।

তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। কৃষ্ণনগরের শীর্ণ রাস্তায় দেওয়াল লেপ্টে দাঁড়িয়ে মানুষ— ‘ওই ঠাকুরটা দেখ কেমন দুলছে...এই রে পাল পাড়ারটাও বেরিয়ে পড়ল যে, একই সঙ্গে এ বার!’’

উত্তেজনার সঙ্গে কিঞ্চিৎ আশঙ্কাও কি লেপ্টে থাকল?

শহরের পুরনো বাসিন্দা অবিনাশ বিশ্বাস কোনও আড়াল না রেখেই বলছেন, ‘‘তা আর বলতে। তিন বছর ধরে, ভাসান মানেই খুনোখুনি, রক্তপাত। তাতেও মানুষের ইৎসাহে খামতি নেই, যত্তোসব!’’ বিরক্তি ঝরছে তাঁর চোখে-মুখে। এ বার?

উদ্বেগ নিয়ে এ বার, সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে কৃষ্ণনগর।

এই তো বছর দুয়েক আগে— দুই প্রতিমা কাছাকাছি আসতেই গতি বাড়িয়ে হা-রে-রে-রে করে দৌড় শুরু করেছিল বেহারারা। দর্শনার্থীদের কাছে ‘ঠাকুর’ কাঁধে বেহারাদের এই দৌড়টাই তো দেখার মতো।

কিন্তু ওটা কি? প্রতিমা চলে যেতেই দেখা গেল রাস্তায় পড়ে রয়েছে রক্তাত্ত এক যুবক। পেটে বিঁধে ধারাল ছুরি। রাস্তার রং কালচে লাল।

শহরের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলছেন, ‘‘আসলে সংঘর্ষ, প্রাণহানি এই শহরে ঠাকুর ভাসানের ঐত্যিহ্যের মতো। হাজার চেষ্টা করেও তা রোখা যাচ্ছে না।’’

প্রতিমা বিসর্জনে নদিয়া পুলিশের মূল পরীক্ষাটা অবশ্য জগদ্ধাত্রী পুজোয়। তাই কালী প্রতিমা বিসর্জন পুলিশের কাছে কার্যত সেমি ফাইনাল বলা যেতে পারে।

বিসর্জনে গোলমাল ঠেকাতে এ বার তাই পুলিশের অন্যতম পদক্ষেপ মদের উপর রাশ টানা। গত দু’দিনে শহরে ১০৫ জন মদ্যপ যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় দু’হাজার লিটার মদ। সোমবার শহরে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মদের দোকানগুলিকেও। পুলিশ জানিয়েছে, প্রিভেনটিভ অ্যারেস্ট করা হয়েছে অন্তত পাঁচশো জনকে।

কৃষ্ণনগরের ইতিহাস বলছে, ভাসানে গোলমালের শুরু শক্তি প্রদর্শন সূত্র ধরে।

আগে রাজা এবং রানির সামনে দিয়ে বর্নাঢ্য ভাসান যাত্রা হত। প্রতিমা যেত রাজবাড়ি হয়ে জলঙ্গিতে। রাজছত্র ভেঙে পড়লেও সে প্রথা রয়ে গিয়েছে। এ দিকে শহরের প্রধান রাস্তা একটিই। বছরকয়েক আগে রাজবাড়ি যাওয়ার রাস্তা আলাদা করা গেলেও অনেক সময়েই বিসর্জনের দু’টি দল মুখোমুখি হয়ে পড়ে। বিপত্তি ঘটে তখনই।

পুলিশের একটি সূত্রে বলছে, বিসর্জনের আড়ালে দুষ্কৃতীরা পরস্পরের উপরে হামলা চালায়। আর তারই মাশুল গুনতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। বছর দুয়েক আগেও কালী প্রতিমার ভাসানের শোভাযাত্রায় আমিনবাজারের কাছে হাজার হাজার মানুষের মাঝখানে ইট দিয়ে থেঁতলে খুন করা হয়েছিল এক যুবককে। কাদের প্রতিমা আগে যাবে রেষারেষি ছিল তা নিয়েই। শিউরে উঠেছিল শহরবাসী। তারও বছর কয়েক আগে দুই বারোয়ারির মধ্যে গন্ডগোলে গুলি চলে। দুবছর আগেও গুলিতে মৃত্যুর ঘটনার সাক্ষী রয়েছে কৃষ্ণনগর।

এ বার তাই, কোতোয়ালি থানার পুলিশ ছাড়াও মোতায়েন করা হয়েছে তিনশো বাড়তি পুলিশ কর্মী।থাকছে সাড়ে চারশো সিভিক ভলান্টিয়ার। ভাসানের রাস্তায় রাজবাড়ি থেকে জলঙ্গির কদমতলা ঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হচ্ছে ২১টি সিসি টিভি ও পাঁচটি ভিডিও ক্যামেরা। ১৬টি মোটরবাইকে দু’জন করে পুলিশ কর্মী টহল দেবেন ওই এলাকা। বিসর্জনের রাস্তায় বিভিন্ন মোড়ে দায়িত্বে থাকবেন জেলার অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসাররা।

ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকবেন সাদা পোশাকের মহিলা ও পুরুষ পুলিশ কর্মী। রাস্তার ডিউটিতে থাকছেন দেড়শ’ জন মহিলা পুলিশ। জেলার বাইরে থেকেও শ’খানেক পুলিশ কর্মী আনা হচ্ছে। তার মধ্যে ৪০ জন অফিসার। গতবারও প্রায় এমনই নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই বিসর্জনের আয়োজন করা হয়েছিল। তার মধ্যেও একাধিক সংঘর্ষ, ইট ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এবার সে সুযোগটুকুও দিতে রাজি নন জেলা পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া। বলছেন, “যে কোনও ধরনের অশান্তি বরদাস্ত করা হবে না। আমরা সব দিক দিয়েই তৈরি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kali puja violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE