আলোকশিখায়...। রাজাপুরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
রথ মানেই বৃষ্টি। ফলে বৃষ্টির আশঙ্কা ছিলই। তবু বিকেলের পর থেকে দফায় দফায় বৃষ্টি নবদ্বীপ-মায়াপুরের রথযাত্রাকে কাকভেজা করে ছাড়ল। মুষলধারার বৃষ্টিতে জগন্নাথ দেব একা পড়ে রইলেন রথে।
এমনিতে ক’দিন ধরেই চলছিল লাগাতার বৃষ্টি। মঙ্গলবার যেন আকাশ ভেঙে নেমেছিল। কয়েক ঘণ্টায় ৫১ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি। পথঘাট জল থই থই। অবস্থা দেখে মাথায় হাত পড়েছিল নবদ্বীপ মায়াপুরের। কেন না নদিয়ায় গঙ্গার দুই তীরের জোড়া পর্যটন কেন্দ্রের উৎসব মরশুম রথের দড়িতে টান পড়তেই শুরু হয়ে যায়। পর্যটন নির্ভর নবদ্বীপ মায়াপুরের মরশুম শুরুর সময়ে এমন দুর্যোগ। সাতদিনে প্রায় ৯৬ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিতে মুখে হাসি ছিল না কারুর। বিভিন্ন মঠমন্দিরের রথের আয়োজন বানচাল হওয়ার উপক্রম। বুধবার সকাল থেকে আকাশের মুখ গোমড়া থাকলেও দিনের বেলায় বৃষ্টি তেমন হয়নি। কিন্তু বিকেলের পর থেকেই ফের দফায় দফায় প্রবল বৃষ্টি।
বৃষ্টির আশংকায় এবার রথযাত্রা লোক সমাগম অনান্য বছরের তুলনায় কম ছিল। রথের আগের দিন সন্ধ্যায় ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস আশংকা প্রকাশ করেছিলেন, “আকাশের যা অবস্থা, তাতে জানিনা কি বুধবার রথযাত্রা কি ভাবে হবে।” দুর্ভাবনার মধ্যে ছিলেন মায়াপুর যোগপীঠ মঠ কর্তৃপক্ষ। ওঁদের এবার প্রাক শতবর্ষের রথ। ফলে আড়ম্বরও ছিল বেশি।
পাশাপাশি গুলশন-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে রথ উপলক্ষে মায়াপুরের রাজপুর জগন্নাথ মন্দির থেকে ইস্কন মন্দির পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড থেকে পুলিশ কুকুর দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল ধুবুলিয়া থেকে নবদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত। বেলা গড়াতেই যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন নদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তন্ময় সরকার।
বৃষ্টিধোয়া রথে এবার নবদ্বীপের পথে বিশেষ ভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে জগন্নাথ দেব এবং তাঁর ভক্তদের। শহরে ভূগর্ভস্থ জল এবং বিদ্যুতের লাইনের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির জেরে নবদ্বীপের অধিকাংশ রাস্তাই চলাচলের অযোগ্য। বৃষ্টিতে সেই সব পথে রথ নিয়ে যেতে কালঘাম ছুটেছে উদ্যোক্তাদের। কোন কোন রথের যাত্রাপথও ছোট করতে হয়। একই ভাবে ষ্টেশন বা খেয়াঘাট যেতে নাজেহাল হতে হয় পর্যটকের দল।
এই পথেই দুপুরের পর থেকে গড়াতে শুরু করে রথের চাকা। চৈতন্যধাম নবদ্বীপে রথযাত্রার ইতিহাস কমপক্ষে তিনশো বছরের পুরানো বলেই মনে করা হয়। গবেষকেরা বলেন কোন রথ সেকালের জমিদার বাড়ির উদ্যোগে চালু হয়েছিল। কোন রথের প্রচলন করেন ভিন রাজ্যের রাজকন্যা। কোনটি আবার যাত্রা শুরু করেছিল কোন সাধু বা বৈষ্ণবের হাত ধরে। কোন রথ আবার ওপার বাংলায় যাত্রা শুরু করে নানা পট পরিবর্তনের ফলে এখন চৈতন্যধামে।
জগন্নাথ বাড়ির বালক সাধুর রথ, মনিপুর রাজকন্যা পরম বৈষ্ণব বিম্বাবতি মঞ্জরী দেবী ইচ্ছায় মনিপুর রাজবাড়ির রথ, দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের রথ, সারদেশ্বরী আশ্রমের সন্ন্যাসিনীদের রথ, তালিকা দীর্ঘ। কালের নিয়মে এরমধ্যে থমকে গিয়েছে একাধিক রথের চাকা। কোন রথের চাকার থেমে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। অন্যদিকে থেমে যাওয়া প্রাচীন রথ আবার চলতে শুরু করেছে এমন নজিরও রয়েছে। সোয়া’শ বছর আগে চট্টগ্রামে সূচনা হয়েছিল মহাত্মা শচীনন্দনের রথযাত্রা। পড়ে সেই রথ চলে আসে নবদ্বীপে। তাঁর মৃত্যুর পর থেমে গিয়েছিল সেই রথ। বছর কয়েক ধরে প্রাচীন মায়াপুরের গিরিধারি আশ্রম থেকে ফের চলছে সেই রথ।
শহরের পথের ধুলোয় সবচেয়ে প্রাচীন যে রথের চাকার চিহ্ন আঁকা হয়, সেটি মনিপুর রাজবাড়ির রথ। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে। মনিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ নবদ্বীপে আসেন ১৭৯৭ সালে। তাঁর কন্যা বিম্বাবতি মঞ্জরি মহাপ্রভু দর্শনের স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন। ১৮০৩ সালে ভাগ্যচন্দ্রের মৃত্যুর পর কুমার চৌরজিৎ সিংহ বোন বিম্বাবতি মঞ্জরীর ইচ্ছানুসারে নবদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। তখন থেকেই নবদ্বীপে মনিপুর রাজবাড়ির রথের সুচনা। উল্টোরথ পর্যন্ত এখানে প্রতি সন্ধ্যায় মণিপুরী নাচের সঙ্গে জয়দেবের পদ গেয়ে জগন্নাথের সন্ধ্যারতি এই রথযাত্রাকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। ১৯৫০ সাল থেকে নবদ্বীপের পথে নামে এক আশ্চর্য রথ। সারদেশ্বরী আশ্রমের রথ। যার সবটাই পরিচালনা করেন সন্ন্যাসিনীরা। এমন রথ বিরল।
রথ উপলক্ষে বিভিন্ন মন্দিরে ষোড়শ ব্যঞ্জনে ভোগের ব্যবস্থা হয়ে ছিল। ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরে এদিন বিশেষ ভোগ দেওয়া হয়। তবে মায়াপুরে ইস্কন মন্দিরে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়িতে ভোগের আয়োজন আন্তর্জাতিক। পাস্তা থেকে পায়েস, পিৎজা থেকে পুষ্পান্ন কিম্বা পুডিং থেকে পান্তুয়া। বিস্কুট থেকে বাতাসা, কেক থেকে কচুরি। চাউমিন থেকে চপ। সোজারথ থেকে উল্টোরথ পর্যন্ত আটদিন মাসির বাড়িতে জগন্নাথ দেবের ভোগের তালিকায় দেশি-বিদেশি হাজারো ব্যঞ্জনের এমনই সহাবস্থান এখন নবদ্বীপ বা মায়াপুরের মন্দির গুলিতে। এখানে বহু মন্দিরেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি বা গুন্ডিচা নেই। তাই বলে মাসির আদরের কোন ঘাটতি নেই। বরং জগন্নাথের ভোগে জন্য এমন দেশি-বিদেশি ব্যঞ্জনের আন্তর্জাতিক আয়োজন খুব কম জায়গাতেই হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy