প্রাচীন পোড়ামা তলা জগদ্ধাত্রী।
বছর কয়েক আগের কথা। ঐতিহ্যবাহী বুনো রামনাথের ভিটেয় অবস্থিত বঙ্গবিবুধজননী সভা পরিদর্শনে এসেছেন জেলা শিক্ষা দফতরের কর্তারা। সংস্কার হবে শতাব্দীপ্রাচীন ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
দীর্ঘদিন তালাবন্ধ ঘরের দরজা খুলে চমকে গিয়েছিলেন সবাই। ঘরের ছাদ ফুঁড়ে নামা গাছের শিকড় দেওয়াল বেয়ে নেমেছে মাটিতে। ঘর ভর্তি আলমারি ঠাসা দুষ্প্রাপ্য পুথি উইয়ে খেয়ে মাটি করে ফেলেছে! একশো তেত্রিশ বছরের প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্রের হাল দেখে সে দিন প্রকাশ্যেই চোখের জল মুছতে দেখা গিয়েছিল নবদ্বীপের প্রবীণ পণ্ডিতমশাইদের।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি হিসাবে বাঙালির সুনাম চিরকালের। নবদ্বীপও তার ব্যতিক্রম নয়। অথচ, নবদ্বীপের মতো হাজার বছর ধরে জীবিত শহর খুব বেশি নেই এই দেশে। তিনশো বছর ধরে গঙ্গার ভাঙনে খণ্ড-বিখণ্ড ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ এখনও টিঁকে আছে। এখনও এ শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রাচীন মূর্তি, বিগ্রহ, মন্দির, দুষ্প্রাপ্য পুথি এবং নানা স্মারক।
কিন্তু অতীত ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান যেমন যত্নে থাকার কথা, সে ভাবে নয়। নিতান্ত অনাদরে, অবহেলায় হাজার, দেড় হাজার বছরের পুথি বন্যার পলিতে জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। নজরদারির অভাবে বুনো রামনাথের ভিটেয় থাকা দুর্লভ পুঁথি উইপোকায় খেয়ে মাটি করে ফেলেছে। কখনও সুযোগসন্ধানীরা গোপনে মোটা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য পুথি।
সপ্তদশ শতকে গড়ে ওঠা নবদ্বীপের প্রথম বৈষ্ণব আখড়ার নাটমন্দির স্থানীয় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মালগুদামে রূপান্তরিত হয়েছে। ভাঙা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী তোরণ। শহর জুড়ে রয়েছে ছোট-বড় দেড় শতাধিক মঠমন্দির। তাতে আছে প্রাচীন বিগ্রহ, পুথি, গ্রন্থ বা অন্য কোনও বহুমূল্য স্মারক। কিন্তু নবদ্বীপে এমন কোনও মঠমন্দির খুঁজে পাওয়া ভার, যেখানে কখনও চুরি হয়নি। পাথর কিংবা ধাতুনির্মিত বহুমূল্য সুপ্রাচীন মূর্তির চুরির তালিকা দীর্ঘ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব চুরির কোনও কিনারা হয় না। দুষ্কৃতীদের চোখে ধুলো দিতে নবদ্বীপের কোনও কোনও মন্দিরে মূল্যবান ধাতব মূর্তি কালো রং করে রাখা আছে। কোনও মন্দিরে চোরের ভয়ে সারা বছর দেবতাকে নকল অলংকারে সাজিয়ে রাখা হয়।
“নিরাপত্তাহীন উদ্বিগ্ন রাত যাপন এই শহরের মঠ-মন্দির প্রধানদের ভবিতব্য!” সখেদ মন্তব্য নবদ্বীপের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস।
প্রাচীন পরিবার যাদের সংগ্রহে প্রাচীন বিগ্রহ, পুথি বা মূল্যবান স্মারক আছে, তাদের রাতও কাটে দুশ্চিন্তায়। নবদ্বীপের ঐতিহ্যবাহী বিগ্রহের মধ্যে বাসুদেব সার্বভৌম সেবিত বৃন্দাবন চন্দ্রের বিগ্রহ চৈতন্যদেবের জন্মের আগে থেকেই নবদ্বীপে রয়েছে বলে মনে করেন গবেষকেরা। শহরের প্রাচীনতম বিগ্রহ এটি। আছে চৈতন্যজায়া বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী সেবিত মহাপ্রভু বিগ্রহ। ১৫১৩ সালে নির্মিত ওই মূর্তির পাদপীঠে খোদিত আছে— ‘১৪৩৫ শক, বংশীবদন।’ রয়েছে ১৬৩০ থেকে ১৬৩৫ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত রাধাবল্লভের কষ্টিপাথরের বিগ্রহ কিংবা ভবতারিণী। কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রাজা রাঘব ১৬৬৯ সালে নবদ্বীপে মন্দির সমেত এক গণেশ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। গঙ্গার ভাঙনে ধ্বংসপ্রাপ্ত সেই মূর্তি ফের নতুন করে ১৮২৩ সালে ভবতারিণী নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
শহরের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে আছে এমনই সব ঐতিহ্যশালী নিদর্শন। সবই প্রায় ভগ্নদশায়। কে রক্ষা করবে এই ঐতিহ্যের স্মারক, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy