মৃতের দুই ছেলে রকি ও রনি। ইনসেটে রামকৃষ্ণ মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র।
প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় নেহাতই দুই পাড়ার ছোটদের মধ্যে গণ্ডগোল। পরে তাতে জড়িয়ে পড়েন বড়রাও। আর সেই গণ্ডগোলের জেরে কুপিয়ে খুন করা হল এক ব্যক্তিকে। সোমবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে কৃষ্ণনগরের দোগাছি গ্রামে। নিহতের নাম রামকৃষ্ণ মণ্ডল (৩৬)। তাঁর বাড়ি দোগাছি মধ্যপাড়া এলাকায়। তিনি নদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসকের (জেলা পরিষদ) গাড়ির চালক ছিলেন। গুরুতর জখম অবস্থায় আরও তিন জনকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
ওই খুনের ঘটনায় স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার নাম জড়িয়ে যাওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূল নেতৃত্ব। যদিও তা মানতে নারাজ তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত। তিনি বলেন, “নিহত ও অভিযুক্ত সকলেই আমাদের দলের লোক। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। এটা নিছকই গ্রাম্য বিবাদের ফল।” বিজেপির মুখপাত্র সৈকত সরকারের কটাক্ষ, “ওটা গ্রাম্য বিবাদ না তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিজয়ার রাতে অঞ্জনা নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য দোগাছি গ্রামের ভিতর দিয়ে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা প্রতিমা নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় রাত ৯ টা নাগাদ গ্রামের তেঁতুলতলা ও মধ্যপাড়ার জনা কয়েক কিশোর প্রথমে বচসা ও পরে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। তাতে তেঁতুলতলাপাড়ার দুই কিশোর জখম হয়ে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এলাকায় উত্তেজনা থাকায় গণ্ডগোলে জড়িত মধ্যপাড়ার দুই কিশোর প্রাণভয়ে আত্মীয়ের বাড়ি পালাচ্ছিল। অভিযোগ, সেই সময় তেঁতুলপাড়ার কয়েকজন যুবক আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে তাদের তুলে নিয়ে আসে নির্মল সরকার নামে স্থানীয় ওই তৃণমূল নেতার ইটভাটায়। সেখানে তাদের আটকে বেধড়ক মারধর করা হয়। ওই কিশোরদের একজন বলে, “তেঁতুলতলাপাড়ার কয়েকজন ছেলে ভাসান চলাকালীন আমাদের ক্লাবের সামনে মদ খেয়ে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করছিল। আমরা তার প্রতিবাদ করলে তারা আমাদের উপরে চড়াও হয়। পরে তাদের পাড়ার লোকজন এসে যোগ দেন।” ওই কিশোরের কথায়, “এলাকায় উত্তেজনা থাকায় আমরা ভয়ে দু’জনে মাসির বাড়িতে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিরে আসতাম। কিন্তু ওরা আমাদের আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে নির্মল সরকারের ইট ভাটায় তুলে নিয়ে আসে।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ওই ঘটনার পরে দুই পাড়ার লোকজনই বদলা নেওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকেন। ওই কিশোরদের মধ্যে রামকৃষ্ণবাবুর দু’জন ভাইপোও ছিল। আর সেই কারণেই মধ্যপাড়ার বাসিন্দা রামকৃষ্ণবাবুও ওই ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। সোমবার রাতে রামকৃষ্ণবাবু বাড়ি ফিরলে তাঁকে নিয়ে পাড়ার কয়েকজন তেঁতুলতলাপাড়ায় যান। অভিযোগ, সেখানে তাঁদের উপরে চড়াও হয় তেঁতুলপাড়ার কিছু লোকজন। অন্ধকারের মধ্যেই তাঁদের এলোপাথাড়ি কোপানো হয়। কয়েকজন পালিয়ে যেতে পারলেও রামকৃষ্ণবাবু-সহ চার জন পালাতে পারেননি। খবর ছড়িয়ে পড়তে রামকৃষ্ণবাবুর স্ত্রী ঝর্ণাদেবী কয়েকজন প্রতিবেশী মহিলাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। ঝর্ণাদেবী বলেন, “গিয়ে দেখি আমার স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে রয়েছে। চারদিকে গ্রামের লোকজন ঘিরে রয়েছে। কিন্তু কেউই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন না। জল খেতে চাইছিল। কিন্তু কেউই ভয়ে জল দেওয়ারও সাহস পাচ্ছিলেন না।” এরপর ঝর্ণাদেবী আবার বাড়ি ফিরে এসে এক প্রতিবেশীর ভ্যান নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। তিনি নিজেই অন্য মহিলাদের সাহায্যে রামকৃষ্ণবাবুকে ভ্যানে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই মারা যান রামকৃষ্ণবাবু।
হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে নিহতের দাদা রাধারমণ মণ্ডল বলেন, “রাতে নির্মলবাবু ভাইকে ফোন করে ডাকে আলোচনা করার জন্য। সেই কারণে আমরা কয়েকজন মিলে গিয়েছিলাম। তেঁতুলতলায় পৌঁছতেই ওরা অন্ধকারে আমাদের উপরে আচমকা ঝাপিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে নির্মলবাবুও ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ওরা ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের কোপানো হয়েছে।” ঘটনার পরেই কোতোয়ালি থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে তল্লাশি শুরু করে। ঘটনার পরে কার্যত পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে দোগাছির তেঁতুলতলাপাড়া।
নির্মলবাবুর স্ত্রী সুতপাদেবীর অবশ্য দাবি, “আমার স্বামীকে অহেতুক এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। তিনি নির্দোষ।” যদিও তিনি স্বীকার করেছেন ঘটনার পর থেকে তাঁর স্বামী বাড়ি ছাড়া। এমনকী ঘটনার পর থেকে তাঁর মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে রামকৃষ্ণবাবু আমাদের গাড়ি চালাচ্ছেন। খুবই ভদ্র আর ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। পুলিশকে বলেছি অপরাধীদের দ্রুত ধরতে।” জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “দশমীর দিন ভাসানের সময় দুই পাড়ার বাচ্চাদের মধ্যে গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েন বড়রাও। সেই গণ্ডগোলের জেরেই এই খুনের ঘটনা ঘটেছে।” এখনও পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ঘটনার পরে গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy