অবসরের পরে দীর্ঘদিন ধরে প্রাপ্য বকেয়া না মেটানোয় নৈহাটির নদিয়া চটকল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম-আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ৯২ জন শ্রমিক। কিন্তু যে আদালতের ভরসায় তাঁরা বুক বেঁধেছিলেন শ্রম দফতরের সেই আদালতের বিচার নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। শ্রমিকদের অভিযোগ, কল্যাণীর সহকারী শ্রম-কমিশনারের কাছে আবেদন করলেও তাঁদের শুনানির জন্য তলব করা হয়েছে কল্যাণীতে নয়, রানাঘাট কিংবা কৃষ্ণনগরে। শ্রমিক স্বার্থেই তৈরি হয়েছে শ্রম-আদালত। শ্রম-আইনানুসারে যে এলাকায় শ্রমিকরা তাঁদের বকেয়া বিষয়ে মামলা করেছেন সেই এলাকাতেই শুনানির জন্য তাঁদের তলব করার কথা। এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হল কেন?
শ্রম দফতরের কাছে তার কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি। রাজ্যের শ্রম-দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “এমনটা হওয়ার কথা নয়। কল্যাণীর সহকারী শ্রম-কমিশনারের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলে জানতে চাওয়া হবে, স্থান পরিবর্তনের কারণ কী।”
পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পরে আপাতত নৈহাটির ওই চটকলটি চালু রয়েছে। তবে শ্রমিকেদর বকেয়া নিয়ে ওই চটকল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযোগ অব্যাহত। নৈহাটি ও তার লাগোয়া এলাকায় নদিয়া চটকলের কয়েক হাজার শ্রমিকের বসত। অবসর নেওয়া কয়েক হাজার শ্রমিকেরও ঠিকানা আশপাশের শ্রমিক-বস্তি। নিজেদের প্রাপ্য আদায়ের জন্য বছরের পর বছর মালিকপক্ষের দরজায় ঘুরলেও বকেয়া আদায় সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে তাঁরা আদালত পর্যন্ত পৌঁছতেও পারেন না স্রেফ অর্থাভাবে। এ অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত ওই শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছিল চন্দননগরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, আইনি সহায়তা কেন্দ্র। তারাই শ্রমিকদের নিখরচায় আইনজীবীর ব্যবস্থা করে দেওয়ায় সম্প্রতি ৯২ জন শ্রমিক কল্যাণীর শ্রম-আদালতে বকেয়া গ্র্যাচুইটির দাবিতে নদিয়া চটকল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার ফল হয়েছে উল্টো। কল্যাণীর বদলে শ্রম-আদালত সেই মামলার শুনানি জন্য শ্রমিকদের তলব করেছে কৃষ্ণনগর এবং রানাঘাটে। অভাবক্লিষ্ট শ্রমিকদের পক্ষে শ্রম দফতরের ওই দূরবর্তী অফিসে শুনানির জন্য যেতে হবে কেন,এ প্রশ্ন তুলে তাই খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দরবার করেছেন তাঁদের আইনজীবী। নদিয়া জুট মিল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, শুনানি কোথায় ফেলা হবে তা শ্রম-দফতরের ব্যাপার। ওই চটকলের এক কর্তা বলেন, “তবে এটুকু বলতে পারি এই জুটমমিল থেকে অবসর নেওয়া শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা গ্র্যাচুইটি পাননি তাঁদের কাগজপত্রে নিশ্চয় কোনও হণ্ডগোল রয়েছে।”
শ্রমিকদের হয়ে মামলা করেছেন পরিবেশ দফতরের প্রাক্তন মুখ্য আইন-অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি শ্রমিকদের অবসরকালীন পাওনা নিয়ে লড়াই করে আসছেন। তাঁর অভিযোগ, কল্যাণীর বদলে রানাঘাট কিংবা কৃষ্ণনগরে শুনানি ফেলা নিছকই ‘ষড়যন্ত্র’। বিশ্বজিৎবাবুর ব্যাখ্যা, “শ্রমকর্তাদের একাংশের লক্ষ্যই হল মালিকপক্ষের স্বার্থ সুরক্ষিত করা। তাই কল্যাণীর পরিবর্তে রানাঘাট-কৃষ্ণনগরকে বাছাই করা হয়েছে।” চটকলের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের সংগঠন, ‘অবসরপ্রাপ্ত জুটমিল শ্রমিক মঞ্চ’ সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানাচ্ছে, ৩০,৪০০ জন শ্রমিক এখনও তাদের গ্র্যাচুইটি পাননি। তারই দাবিতে এক জোট হয়ে অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকরা গড়েছেন ওই সংগঠন।
ওই মঞ্চের অভিযোগ, অভাবী শ্রমিকদের পক্ষে বার বার দূরের কোনও জায়গায় শুনানিতে হাজির হওয়া সম্ভব নয়। এ কথা শ্রম-দফতরের কর্তারা জানেন। অনেক সময়েই তাঁরা শুনানিতে হাজির না হওয়ায় মামলা খারিজ হয়ে যায়। মালিক পক্ষের স্বার্থ রক্ষায় তাই ‘ষড়যন্ত্র’ করেই কল্যাণীতে নয়, শুনানি ফেলা হয়েছে রানাঘাট, কৃষ্ণনগরে। কল্যাণীর সহকারী শ্রম-আধিকারিক অবশ্য এ ব্যাপারে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তা হলে রানাঘাট বা কৃষ্ণনগর ছুটতে হবে কেন শ্রমিকদের? উত্তর মেলেনি।