থলির ভিতরে কোনওরকমে বাজারটা ভরে বাড়ির দিকে এক প্রকার হনহনিয়ে ছুটলেন সুকোমল রায়। কলকাতার এক সরকারি দফতরের কর্মী। এক কালে কলেজে চুটিয়ে ছাত্র রাজনীতি করেছেন। এখন সপ্তাহে পাঁচ দিন ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। আর ক’জন নিত্যযাত্রীর মতো তিনিও রবিবারগুলো একটু সময় নিয়েই বাজার করেন। সারা সপ্তাহের জন্য নানা কেনাকেটা করতে একটু বেলা হয়ে যায়। তার উপরে আবার বন্ধুদের সঙ্গে মোড়ের দোকান থেকে দু’পাত্তর চা-ও খাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু আজ আর সময় কোথায়?
এই রবিবারটা ব্যতিক্রম। একেবারেই অন্য রকম। কেন? মুচকি হেসে সুকোমলবাবু বলেন, “সারা সপ্তাহ তো সময় পাই না। সপ্তাহান্তের এই দু’টো দিনটার জন্যই তো অপেক্ষা করে থাকি।” কিন্তু কেন? এ বার হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, “দু’দিনেই গোটা পাড়া চষে ফেলতে হবে। প্রতিটা বাড়ি বাড়ি যেতে হবে। তবেই না প্রচার।” তিনি বলেন, “সারা সপ্তাহে আমার দলের কর্মীরা প্রচার করে। রাতে বাড়ি ফিরে সে সব গল্প শুনি। প্রাণটা ছটফট করে। এই দু’দিন তাই প্রচারে কোনও রকম ঘাটতি রাখতে রাজি নই।” এমনটা যে ভোটের আগে প্রতিটা ছুটির দিনগুলিতে চলবে। তা কিন্তু জানিয়ে দিতে ভোলেননি তিনি। শুধু তিনিই নন, সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সব নিত্যযাত্রীরই যে এটা মনের কথা, তা বিলক্ষণ জানেন সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই। তাই ছুটির দিনগুলিতে নিত্যযাত্রীদের প্রচারের কাজে ব্যবহারে যাতে এতটুকু ঘাটতি না থাকে, তার জন্য সতর্ক নজর থাকে সব দলেরই।
তাই গরম যতই পড়ুক, সপ্তাহান্তে ভোটের প্রচারে উত্তপ্ত কৃষ্ণনগর।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সদ্য শেষ হয়েছে। মাইক বাজানোর এখনও অনুমতি না মিললেও বাড়ি বাড়ি প্রচারের কাজে এতটুকু ঘাটতি রাখতে রাজি নয় কোনও দলই। বাড়ি বাড়ি প্রচার দ্রুত শেষ করে সব দলের কর্মীরা চাইছেন সরাসরি ভোটারদের কাছে পৌঁছতে। আর সেটা করতে গেলে ছুটির দিনগুলো কোনও ভাবে হেলায় নষ্ট করলে চলবে না। কারণ কৃষ্ণনগর বা তার সংলগ্ন এলাকার ভোটারদের এক বিরাট অংশ চাকুরিজীবী। তাদের সকলেই যে ট্রেনে নিত্যযাত্রী তা নয়। কিন্ত কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য তাদের কিন্তু বাড়ি থাকা হয় না। ছুটির দিনে তাদের পাওয়া সহজ। সময় নিয়ে দু’দন্ড কথাও বলা যায়। ছুটির দিনে সকলে একটু হালকা ‘মুডে’ থাকেন। ফলে কথা বলাও অনেকটা সহজ হয়। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চায় সব দলই। তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “এমনিতেই তাপস পালকে নিয়ে আমাদের কর্মিসভাগুলি মানুষের ভিড়ে জনসভার আকার নিচ্ছে। কিন্তু তার পরেও ছুটির দিনগুলি ছাড়া চাকরিজীবীদের কাছে পৌঁছান কঠিন। তাই শনি-রবিবার আমাদের কর্মীদের ঝাপিয়ে পড়তে বলেছি। এই দুটো দিন আমরা প্রচারে কোনও রকম ঘাটতি রাকতে রাজি নই। এই দু’দিনে প্রতিটি চাকুরিজীবীর কাছে পৌঁছে যেতে হবে।”
যত দিন যাচ্ছে প্রচারের উত্তোজনার পারদ তত বাড়ছে। আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোদ। সকাল থেকে তাই সিপিএম এর কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লিফলেট দিয়ে প্রচারের কাজ করছেন। পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন প্রতিটি ভোটারের কাছে। দুপুরের চড়া রোদে প্রচার বন্ধ রেখে বেলা পড়লে বিকেলে আবার প্রচার শুরু। তখন অবশ্য পাড়া বৈঠকের দিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন তাঁরা। সিপিএম এর জেলা কমিটির সদস্য সুমিত বিশ্বাস বলেন, “বাড়ি বাড়ি প্রচার প্রায় শেষ। এবার আমরা প্রতিটি ভোটারের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। আর সেটা করার জন্য শনি-রবিবার ছুটির দিনগুলি সব চাইতে উপযুক্ত। আর সেটার জন্য এই শনি ও রবিবার ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে এ বার বিজেপি গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। প্রচারের ময়দানে তারাও তাই এতটুকু জমি ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তৃণমূলের তাপস পাল, সিপিএম এর শান্তনু ঝা-র মত লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন বিজেপি-র প্রার্থী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। কিন্ত তার পাশাপাশি কর্মীরাও তাদের নিজের নিজের এলাকায় সমান ভাবে প্রচারে নেমে পড়েছেন। ব্লক ও পঞ্চায়েত স্তরে কর্মিসভা শেষ করে তারা বুথ ভিত্তিক এলাকা ধরে ‘পরিবার চলো’ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার কাজে ঝাপিয়ে পড়েছেন। কর্মীরা পৌঁছে যাচ্ছেন বাড়ি বাড়ি। দলের মুখপাত্র সন্দীপ মজুমদার বলেন, “আমাদের দলের একটা বড় অংশ কর্মী চাকুরিজীবী। শনি ও রবি ছুটির দিন গুলিতে তাদের পুরোপুরি প্রচারের কাজে পাওয়া যায়। এই দুদিন তাই আমরা প্রচারের কাজে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছি। তাছাড়া ‘পরিবার চলো’ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে হলে বাড়ি পুরুষদেরও তো দরকার। সেটা ছুটির দিনেই সব চাইতে ভালো ভাবে করা সম্ভব।”
তবে অন্যদের থেকে অনেকটা পিছিয়ে থেকে প্রচার শুরু করেছে কংগ্রেস। শনিবার প্রথম কৃষ্ণনগরে বিভিন্ন ব্লকের কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন তাদের প্রার্থী রাজিয়া আহমেদ। অন্য দলের প্রার্থীদের দেওয়াল লিখন বা ফ্লেক্স-এ চারদিক ভরে যেতে শুরু করে দিয়েছে। তখন প্রচারের প্রাথমিক কাজটুকুও করে উঠতে পারেনি কংগ্রেস। প্রবল গরমের মধ্যেও রবিবার থেকে সেটাই শুরু হল। এদিনই লোকসভা কেন্দ্রের প্রতিটি ব্লকে কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করলেন তিনি। দলের নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান সোমনাথ দত্ত বলেন, “প্রার্থী ঘোষণা করতে আমাদের একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রচারে আমরা পিছিয়ে থাকতে রাজি নই। আজ রবিবার ছুটির দিন। এই ফাঁকে অমাদের প্রার্থী প্রতিটা ব্লকে গিয়ে কর্মীদের নিয়ে সভা করছেন। দ্রুত অমরা অমাদের প্রচারের ঘাটতি পুরণ করে নিতে পারব।” এভাবেই ছুটির দিনে মাটি কামড়ে থেকে একে বারে তৃণমূল স্তরে প্রচার সেরে নিতে চেয়েছেন সকলে।