নজর নেই। পুরসভার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনই হতশ্রী অবস্থা নবদ্বীপের রানির ঘাটের।—নিজস্ব চিত্র।
ঘটনা-১: অধ্যাপনা থেকে অবসরের পরে নবদ্বীপে গৌরদর্শন এবং গঙ্গা স্নান করতে এসেছিলেন দুর্গাপুরের অরুনাংশু ভট্টাচার্য। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী, কন্যা ও পুত্রবধূ। প্রথম রাত শহরের মঠমন্দির দেখে ভালই কেটেছিল। পরের দিন সকালে সবাই মিলে স্নান করতে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে তাঁদের চক্ষুস্থির হয়ে যায়। নবদ্বীপের রানিরঘাটে নারীপুরুষ মিলিয়ে কয়েক’শো মানুষ স্নান করছেন। কিন্তু স্নানের পরে তাঁদের ভিজে পোশাক বদলানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। প্রকাশ্যে কোনওরকমে পোশাক বদল করছেন সকলেই। স্নানের ঘাটের এই দশা দেখে অধ্যাপকের বাড়ির মহিলারা স্নান করতে রাজি হননি। গঙ্গায় স্নানের আশা ত্যাগ করে মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে বোতলে গঙ্গার জল ভরে নিয়ে তাঁরা ফিরে যান। ফেরার পথে অরুনাংশুবাবুর আক্ষেপ, “নবদ্বীপের মতো জায়গায় গঙ্গার ঘাটে শৌচাগার থাকবে না বা স্নানের পর মেয়েদের পোশাক বদলের ব্যবস্থা থাকবে না, এটা ভাবতেই পারিনি! খুব আশা করে গৌরগঙ্গার দেশে এসেছিলাম। এ সব স্থানীয় প্রশাসনের নজরে পরে না?”
ঘটনা-২: বনগাঁ থেকে সপরিবার নবদ্বীপ-মায়াপুর বেড়াতে এসেছিলেন গোপাল হালদার। স্নানের আগেই দেখে রেখেছিলেন গঙ্গার ঘাটের লাগোয়া হলুদ রঙের ভাঙাচোরা বাড়িটি। তাঁরা ভেবেছিলেন, স্নানের পরে ওখানেই হয়তো মহিলাদের পোশাক বদলানোর ব্যবস্থা রয়েছে। সেই মতো স্নান সেরে গোপালবাবুর পরিবারের মেয়েরা সেই হলুদরঙা ভাঙাবাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই ঘাটের অন্য লোকজন হই হই করে ওঠেন, “ও দিকে নয়, ও দিকে নয়। ওই ঘর নোংরা, সাপখোপের বাসাও রয়েছে।” ভিজে পোশাকে একঘাট লোকের মধ্যে তখন রীতিমতো বিব্রত ওই মহিলারা। ওই ঘাটে সেই সময়ে একই সমস্যায় পড়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর থেকে আসা অনিলচন্দ্র বেরার পরিবারের মেয়েরাও। শেষপর্যন্ত দুই পরিবারের মহিলারা গঙ্গার ঘাটে একে অপরকে কাপড় দিয়ে আড়াল করে কোনও রকমে পোশাক বদলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।
নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নবদ্বীপের শহর অঞ্চলে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে কম করে এক ডজন ঘাটে লোকজন স্নান করেন। তার মধ্যে কিছু লোকজন স্থানীয় বাসিন্দা। কিন্তু অধিকাংশই বহিরাগত পর্যটক। যাঁদের নবদ্বীপে আসার অন্যতম প্রধান একটি উদ্দেশ্য হল গঙ্গায় স্নান করে মহাপ্রভু দর্শন করা। এহেন নবদ্বীপের প্রায় বেশির ভাগ ঘাটেই নেই শৌচাগার, স্নানের পরে পোশাক পরিবর্তনের ব্যবস্থা ও পানীয় জলের ব্যবস্থা। ফলে বারো মাসে তেরো পার্বণের শহর নবদ্বীপে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এসে গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন। অনেকে এমন অবস্থায় স্নান না করেই ফিরে যেতে বাধ্য হন। বছরের পর বছর এমনটাই চলছে। কারও এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই বলেই অভিযোগ। সবার শৌচাগারের মতো নানা প্রকল্পে রাজ্যের মধ্যে প্রথম স্থানে থাকার দাবি করেন জেলা প্রশাসনের বহু কর্তা। অথচ নদিয়ার অন্যতম প্রধান এবং প্রাচীন পর্যটন কেন্দ্র নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে ঘাটে কেন শৌচাগার-সহ অন্য পরিকাঠামো আজ পর্যন্ত গড়ে উঠল না, সে নিয়ে অবশ্য প্রশাসনের কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের’ অধীনে নবদ্বীপের গঙ্গার গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলিতে তৈরি হয়েছিল শৌচাগার-সহ বেশ কিছু ব্যবস্থা। রাজ্যে এবং স্থানীয় পুরসভায় তখন বাম রাজত্ব। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেই সব শৌচাগার এবং পোশাক পরিবর্তনের ঘরগুলি সাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। তারপরেও নবদ্বীপ পুরসভা এবং বিধানসভায় নয় নয় করে বামেরা দেড় দশক কাটিয়েছে। কিন্তু নবদ্বীপের স্নানের ঘাটের ‘লজ্জা’ নিবারনের জন্য ওই শৌচাগারগুলির বন্ধ দরজার তালা খোলার কোনও চেষ্টা করেনি। অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে নবদ্বীপের গুরুত্ব। সারা বছর দেশি বিদেশি পর্যটকের ভিড় জমা শুরু হয়েছে নবদ্বীপ-মায়াপুরে। ঝুলন, রথযাত্রা, বড়দিন, নববর্ষের ভিড়ের পাশাপাশি রাস বা দোলের মতো উত্সবে লাখো মানুষের গন্তব্য হয়ে উঠেছে নবদ্বীপ। শহরের অন্যান্য দিকে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন ঘটলেও নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাট যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই।
ইতিমধ্যে নবদ্বীপের গঙ্গা দিয়ে বয়েছে অনেক জল। বামেদের সরিয়ে নবদ্বীপ বিধানসভা এবং পুরসভার দখল নিয়েছে তৃণমূল। তবুও দরজা খোলেনি বন্ধ শৌচাগারের। কাপড়ের আড়াল তৈরি করে উন্মুক্ত স্নানের ঘাটে মহিলাদের পোশাক বদলানোর সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। উল্টে পঁয়ত্রিশ বছর আগে তৈরি হওয়া সেই সব শৌচাগার এবং পোশাক পরিবর্তনের ঘরগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়েছে। ব্যবহারের অযোগ্য হয়েছে বহু আগেই। সংস্কার করা দূরে থাক দরজা জানলা হারিয়ে সেগুলি এখন নেশাগ্রস্ত এবং দুষ্কৃতীদের নিরাপদ ডেরা উঠেছে।
যদিও নবদ্বীপের উপ পুরপ্রধান তৃনমূলের তুষার ভট্টাচার্য বলেন, “গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের ওই ভবনগুলি কোনওদিন নিয়মমাফিক ভাবে পুরসভার হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনও অর্থও বরাদ্দ করা হয়নি। সর্বোপরি তত্কালীন বাম পুরবোর্ড এগুলিকে সঠিক ভাবে ব্যবহারের কোন ব্যবস্থা করেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।” তুষারবাবু বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই ফাঁসিতলা ঘাটে যাঁরা স্নান করতে আসেন তাঁদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। পুরসভা নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাট নিয়ে যে পরিকল্পনা আগামী দিনে বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়েছে তাতে শুধু শৌচাগার বা পোশাক বদলের ঘর নয়, গঙ্গার ধারের ছবিটাই আমূল বদলে যাবে। গঙ্গার ঘাটকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা, ঘাট বরাবর রাস্তা তৈরি, প্রচুর সংখ্যায় শৌচাগার নির্মাণ সবই করা হবে।”
গঙ্গার ঘাট নিয়ে কোটি কোটি টাকার পরিকল্পনার কথা নবদ্বীপের মানুষ বহুদিন ধরেই শুনছেন। যদিও পর্যটকদের ভরসা এলাকার বাসিন্দা সুজিত দে’র মতো কিছু মানুষের বাড়ি, যেখানে সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে তাঁরা স্নানের পরে নিশ্চিন্তে পোশাক বদলাতে পারেন। ব্যবহার করতে পারেন শৌচাগার।
সুজিতবাবু বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে মানুষের এই সমস্যা দেখে সামান্য পয়সার বিনিময়ে এই ব্যবস্থা করেছি। তাতে ওঁদের যেমন সুবিধা হয় তেমনি আমারও কিছু উপার্জন হয়। তবে উত্সবের দিনে বা বিশেষ তিথিতে এখানে ভীষণ ভিড় হয়ে যায়। এই ছোট্ট জায়গায় সেই ভিড় সামাল দেওয়া যায় না।”
পুরসভার পরিকল্পনা কতদিনে বাস্তবায়িত হয়, এখন সেটাই দেখার।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ,
জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy