কথা ছিল, সরকারি সাহায্যে স্বাস্থ্যকর জৈব ফসল ফলাবেন নদিয়ার চাষিরা। সাতটি গ্রামে হাজার খানেক বিঘেয় জৈব চাষ শুরুও হয়েছে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ভাটার টান সরকারি উৎসাহে। ফলে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক দিয়ে চাষের অভ্যাস ছেড়ে জৈব চাষের দিকে নতুন করে ঝুঁকতে চাইছেন না অনেক চাষি। আর যে চাষিরা বিস্তর ঝুঁকি নিয়ে জৈব চাষ শুর করেছিলেন, তাঁরা পড়েছেন উভয়সঙ্কটে। অনেক বিনিয়োগ করে জৈব চাষ শুরু করার পর রাসায়নিক চাষে ফিরতে পারছেন না। আবার সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় মিলছে না লাভের কড়ি।
সমস্যা ঠিক কোথায়? এক কৃষি কর্তা জানালেন, পরপর তিন বছর জৈব চাষ না করলে জৈব ফসলের শংসাপত্র দেয় না কেন্দ্রীয় সরকার। ওই শংসাপত্র পেলে তবেই বড় ব্যবসায়ী, শপিং মল, হোটেল-রেস্তোরাঁ ‘অর্গানিক’ ফল, সব্জি বা ফসলের দাম দেন। ততদিন জৈব চাষের জন্য বাড়তি যে পরিশ্রম এবং খরচ, তা পোষাতে চাষিদের উৎসাহ ভাতা দেবে রাজ্য সরকার। ২০১২-১৩ আর্থিক বছরের আর্থিক অনুদান মেলে সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিল থেকে। কিন্তু তারপর আর টাকা আসেনি। ফলে চাষি, মাস্টার রিসোর্স পার্সন (এমআরপি), জৈবচাষ বিশেষজ্ঞ, সকলেই বিপাকে।
অন্য দিকে, ফসল সংরক্ষণ কিংবা বিপণনের ব্যবস্থা, কোনওটাই গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়নি সরকার। কথা ছিল, সরকার তৈরি করবে জৈব-বাজার, যেখানে চাষিরা সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন। জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের দাম যেহেতু প্রচলিত ফসলের থেকে বেশি, তাই জৈব ফসলের উপকারিতার বিষয়েও সরকারি তরফে ক্রেতাদের সচেতন করারও কথা ছিল। সে সব হয়নি।
২০১২ সালে নদিয়ার সাতটি ব্লকের (করিমপুর ১, করিমপুর ২, তেহট্ট ১, চাপড়া, রানাঘাট ২, কৃষ্ণগঞ্জ ও হাঁসখালি) সাতটি গ্রামকে বেছে নিয়ে শুরু হয়েছিল জৈব চাষ। লক্ষ্য, ওই সাতটি গ্রামকে পুরোপুরি জৈব গ্রাম হিসাবে গড়ে তোলা। বর্তমানে জেলা জুড়ে প্রায় ১০০০ বিঘায় জৈব চাষ হচ্ছে।
করিমপুর ১ ব্লকের মাস্টার রিসোর্স পার্সন হিসাবে কাজ করছেন পাট্টাবুকার বাসিন্দা বিশ্বনাথ বিশ্বাস। তাঁর প্রশ্ন, জৈব চাষ করতে গিয়ে চাষিরা হয়রান হচ্ছেন, তা দেখলে অন্য চাষিরা কেনই বা রাসায়নিক দিয়ে চাষ ছেড়ে জৈব চাষের ঝুঁকি নেবেন? অথচ চাষিদের বুঝিয়ে জৈব চাষে নিয়ে আসার কাজটা সহজ নয়। করিমপুর ১ ব্লকে জৈব গ্রাম হিসাবে বেছে নেওয়া হয় হরেকৃষ্ণপুরকে। বিশ্বনাথবাবু জানালেন, সেখানকার চাষিদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে ১২৪ জন চাষিকে রাজি করানো হয়েছিল। এখন হরেকৃষ্ণপুরে ২২৭ বিঘা জমিতে জৈব চাষ হচ্ছে। দিনকয়েক আগে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক থেকে কয়েকজন আধিকারিক সরেজমিনে এই এলাকার জৈব চাষ দেখতে আসেন। তাঁরা খুশি হয়ে আর্থিক সহায়তার আশ্বাসও দিয়ে যান। কিন্তু চাষিদের কাছে সেই সহায়তার কিছুই পৌঁছয়নি।
বিশ্বনাথবাবুর অভিযোগ, “শুরুতে এই ব্লকে চাষের জন্য ১৪ লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। সেই শেষ। তারপর এখনও পর্যন্ত আর কোনও টাকা জেলা থেকে আসেনি। ব্লক ও জেলায় বহু বার লিখিত ও মৌখিক ভাবে জানিয়েও লাভ হয়নি।”
একই দশা জেলার অন্য ব্লকগুলোরও। করিমপুর ২ ব্লকে ৬০ জন চাষি ১১০ বিঘা জমিতে জৈব চাষ করছেন। সেই ব্লকের এমআরপি সেলিম মণ্ডল বলেন, “এ রকম চলতে থাকলে আর কতদিন চাষিদের ধরে রাখা যাবে বুঝতে পারছি না। বেশি টাকা খরচ করে যদি উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া না যায় তা হলে চাষিরাই বা কেন চাষ করবেন?”
নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, “জেলায় জৈব চাষ খুব ভাল ভাবেই হচ্ছে। দ্বিতীয় দফার টাকাও আমরা দিয়ে দিয়েছি। খুব শীঘ্র চাষিরা সেই টাকা হাতেও পেয়ে যাবেন। আর জৈব বাজার ও সংরক্ষণ কেন্দ্রও তৈরি করা হবে।”
জৈব চাষের খরচ রাসায়নিক চাষের চাইতে কম। কিন্তু রাসায়ানিক দিয়ে চাষ করা জমিকে জৈব চাষের জন্য তৈরি করতে গেলে জমিতে বেশি পরিমাণে জৈব সার দিতে হয়। তার দাম খুব বেশি না হলেও, তার উপকরণগুলি নিজেকেই জোগাড় করে সার তৈরি করতে হয়। তাই পরিশ্রম অনেক বেশি। ফলে জৈব চাষি অন্য কোনও কাজ থেকে বাড়তি রোজগার করতে পারেন না, জানালেন বিশ্বনাথবাবু। আবার গোড়ার তিন বছর নিজের ফসলের জন্য ‘জৈব’ শংসাপত্র জোগাড় করতে না পারায়, যথাযথ দামও পাওয়া যায় না। সেই জন্যই জৈব চাষ শুরু করার সময়ে চাষিদের জন্য আর্থিক সহায়তা জরুরি। সরকার তার ব্যবস্থা না করায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে চাষিদের। থমকে যাচ্ছে ব্লকে ব্লকে জৈব গ্রাম তৈরির লক্ষ্য।
হরেকৃষ্ণপুরে বেশ কয়েক বিঘা জমিতে জৈব চাষ করছেন স্থানীয় চাষি লক্ষ্মণ প্রামাণিক, অমল সরকার, রোহিনী ভট্টাচার্যরা। তাঁদের কথায়, “বিপণনের কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় মার খেতে হচ্ছে। কারণ, এলাকায় এখনও বেশি দাম দিয়ে জৈব ফসল কেনার ক্রেতা তৈরি হয়নি। আবার ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেই।” মাঝেমধ্যে শিলিগুড়ি কিংবা কলকাতার মতো বড় শহরগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু ফসল বিক্রি করছেন তাঁরা। কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে উৎপন্ন ফসল বিক্রির ব্যবস্থা না থাকায় চাষ লাভজনক হচ্ছে না।
কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকে প্রায় ১৫০ বিঘা জমিতে জৈব চাষ হচ্ছে। ওই ব্লকের চাষি তথা এমআরপি নিমাই মণ্ডল জানান, কৃষ্ণগঞ্জ এলাকায় ভাল সব্জি চাষ হয়। এখন ফুলকপি, লাউ, সিম, লঙ্কা, পালং, মুলো, সবই জৈব পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। সে সব ফসল তাঁরা ফি সপ্তাহে কলকাতায় নিয়ে এসে বিক্রি করেন। দামও ভাল পান। তবে নিমাইবাবুর কথায়, “জৈব চাষের ক্ষেত্রে শংসাপত্র পেয়ে গেলে, এবং স্থানীয় ভাবে জৈব বাজার গড়ে উঠলে চাষিরা আরও বেশি লাভবান হতেন।”
সংক্ষেপে জৈব চাষ
জৈব চাষ কী?
রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক বাদ দিয়ে কেবল জৈব উপাদানে তৈরি সার ও কীটনাশকে চাষ।
কী উপাদান থাকে জৈব সারে?
গোবর, গোমূত্র, চার রকম ডালের বেসন, আখের গুড়, পাকা কলা প্রভৃতি।
কী কী উপাদান থাকে কীটনাশকে?
কাঁচা লঙ্কা, কালমেঘ, ধুতরো, নিম, আকুন্দ, রসুন, হলুদ, তামাক পাতার রস, গোমূত্র।