Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নিকাশি সমস্যায় নাজেহাল শান্তিপুর

অতি প্রাচীন এক জনপদ শান্তিপুর। অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীন পুরসভা। শ্রীচৈতন্যের শিক্ষক অদ্বৈতাচার্য্যের সাধনক্ষেত্র এই শান্তিপুর এক অন্যতম তীর্থ ক্ষেত্রও বটে। শান্তিপুরে পদধুলি পড়েছিল মহাপ্রভুর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্তিপুর এক দিকে যেমন ভক্তিতীর্থে পরিণত হয়েছে, তেমনই বাংলার এক অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ আয়তনে বৃদ্ধি পেয়েছে এই জনপদ। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন কলোনি।

১০ নম্বর ওর্য়াডের খুদে কালীতলায় সারা বছর রাস্তায় জমে থাকে নোংরা জল (বাঁ দিকে)। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে বাঁধেরপাড়ায় আজও কাঁচা মাটির রাস্তা। বর্ষায় চলা দায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

১০ নম্বর ওর্য়াডের খুদে কালীতলায় সারা বছর রাস্তায় জমে থাকে নোংরা জল (বাঁ দিকে)। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে বাঁধেরপাড়ায় আজও কাঁচা মাটির রাস্তা। বর্ষায় চলা দায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

সুস্মিত হালদার
শান্তিপুর শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:১৫
Share: Save:

অতি প্রাচীন এক জনপদ শান্তিপুর। অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীন পুরসভা। শ্রীচৈতন্যের শিক্ষক অদ্বৈতাচার্য্যের সাধনক্ষেত্র এই শান্তিপুর এক অন্যতম তীর্থ ক্ষেত্রও বটে। শান্তিপুরে পদধুলি পড়েছিল মহাপ্রভুর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্তিপুর এক দিকে যেমন ভক্তিতীর্থে পরিণত হয়েছে, তেমনই বাংলার এক অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ আয়তনে বৃদ্ধি পেয়েছে এই জনপদ। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন কলোনি।

শান্তিপুর ওরিয়েন্টাল স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তথা প্রাক্তন পুরপ্রধান মিহির খাঁ দীর্ঘ দিন ধরে শান্তিপুরের উপরে গবেষণা করছেন। মিহিরবাবু জানান, অদ্বৈতাচার্য্যের আসার পর থেকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে এই জনপদ। শান্তিপুরে তাঁর আগমন আর্থ-সামাজিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সঙ্গে অনেক ভক্তও এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তাঁতশিল্পী। অদ্বৈতাচার্য্য মনে করতেন যে, শুধু ধর্ম করলেই হবে না। কর্মও করতে হবে। সেই মতো তাঁর ভক্তেরা তাঁদের পেশা অনুযায়ী কাজও করতে থাকলেন। তাঁত শিল্পে শান্তিপুর দ্রুত সমৃদ্ধ হল। তাঁত শিল্পীদের হাতে প্রচুর অর্থ আসতে শুরু করল। মূলত তাঁদেরই হাত ধরে দ্রুত আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল শান্তিপুর।

তাঁত শিল্পের পাশাপাশি, কাঁসা-পিতলের সামগ্রী, মাদুলি-শিল্প ও নীলের চাষ ছাড়াও চিনির কারবার এই এলাকাকে আরও বেশি করে সমৃদ্ধ করতে থাকে। এখানে চিনির কারখানা থেকে যে পরিমাণ চিনি উৎপাদন হত তা দেশের প্রয়োজন মেটানোর পরে বিদেশে রফতানি হত। বিশেষ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে আর এক প্রাচীন জনপদ সূত্রাগড় এলাকায় চিনির রমরমা কারবার শুরু হয়। মূলত তাঁতের শাড়িকে কেন্দ্র করে শান্তিপুর, আর চিনির কারবারকে কেন্দ্র করে সমৃদ্ধ হতে থাকে সূত্রাগড়। এই শান্তিপুর আর সূত্রাগড়কে নিয়েই এখন শান্তিপুর পুরসভা।

১৮৫৩ সালে দার্জিলিংয়ের পরে শান্তিপুরে পুরসভা তৈরি হয়। গড়ে ওঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাকা নর্দমা, পাকা রাস্তা। পরিকল্পিত ভাবে সাজতে থাকে এই শহর। কিন্তু দেশ ভাগের পর বড় সড় ধাক্কা খেল এখানকার নাগরিক জীবন। ওপার বাংলা থেকে মানুষ দলে দলে শান্তিপুরে এসে উঠলেন। মূলত স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়, ফাঁকা এলাকায় তাঁরা বসতি স্থাপন করলেন। ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়তে থাকল শহরের অন্য এলাকাতেও। তৈরি হল হরেকৃষ্ণ কলোনি, বিনয় বাদল দিনেশ কলোনি, রাজা রামমোহন কলোনি, নবীনপল্লি, রামকৃষ্ণ কলোনি, চৈতন্যপল্লি, বক্তারঘাট নতুন পাড়া, দেশবন্ধু কলোনির মতো একাধিক কলোনি। এক ধাক্কায় শহর অনেকটা বেড়ে গেলেও সেই অনুপাতে শহরের রাস্তা-ঘাট, নিকাশি-সহ তেমন পরিকাঠামো কিন্তু তৈরি হয়নি। ৭১ সালের পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। আরও মানুষ বাংলাদেশ থেকে এসে ভিড় করলেন। আর সেই ধাক্কা আজও সামালতে পারেনি শান্তিপুর পুরসভা।

শহরের একাধিক কলোনি এলাকায় বেশ কিছু রাস্তা আজও কাঁচা। বহু এলাকায় সে ভাবে নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটু সমান জল জমে যায়। ঘরের ভিতরে জল জমে যায়। এছাড়াও শহরের বেশ কিছু জায়গায় সারা বছরই নর্দমার জল উপচে রাস্তায় চলে আসে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, শহরের নর্দমাগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। অপরিকল্পিত ভাবে নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় কোথাও কোথাও হাইড্রেনগুলি অপেক্ষাকৃত উঁচু। ফলে বর্ষায় তার ফল ভোগ করতে হয় এলাকার বাসিন্দাদের। তার উপরে শহরের বেশ কিছু জলাভূমি কোথাও পুরোপুরি কোথাও আবার অংশিক ভাবে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেহাল নিকাশির কথা মেনে নিয়ে পুরপ্রধান অজয় দে বলেন, “নিকাশির জল এখন ব্যক্তিগত পুকুরে ফেলতে দেওয়া হচ্ছে না। তার জন্য আমরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় চারটি পুকুর কিনেছি। সেখানে জল ফেলে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে হচ্ছে। সেই সঙ্গে পঞ্চাননতলা থেকে মালোপাড়ার হয়ে বাইপাস পর্যন্ত একটা বাইপাস হাইড্রেন তৈরি করা হয়েছে। নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য একটা মাস্টার প্ল্যানও তৈরি করা হচ্ছে।”

নিকাশির পাশাপাশি পানীয় জল নিয়েও সমস্যায় রয়েছেন বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। বিরোধীদের অভিযোগ, পুরসভার ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫, ১৬ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে এখনও পর্যন্ত পানীয় জল পৌঁছয়নি। এছাড়া আরও বেশ কিছু ওয়ার্ডে পানীয় জল নিয়ে সমস্যা রয়েছে। পুরসভার বিরোধী দলনেতা সোমেন মাহাতোর অভিযোগ, “নিকাশি, পানীয় জল, রাস্তা, বিদ্যুৎ, শৌচাগারের মতো বহু সমস্যা এখনও রয়েছে। সে বিষয়ে পুরসভা আজও তেমন কিছু করতে পারেনি।”

অজয়বাবু বলেন, “ভাগীরথী নদীর জল পরিশোধিত করে তা সরবরাহ করার কাজ পুরোদমে চলছে। আশা করছি, ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। তখন গোটা শহরেই পর্যাপ্ত জল সরবরাহ করা সম্ভব হবে। সেই মতো শহরের সর্বত্র পাইপ লাইন পোঁতার কাজও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। শহরের মানুষকে আরও ভাল পরিষেবা দিতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।”

তবে এই রাজনৈতিক চাপানউতোরের মধ্যে যেতে চান না শহরের মানুষ। তাঁদের দাবি, রাজনীতি ভুলে যুযুধান সব পক্ষই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শান্তিপুরের উন্নয়নে সামিল হোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE