Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রেক্ষাগৃহের অভাবে ধুঁকছে শান্তিপুরের নাট্যচর্চা

শান্তিপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস শুধু সুপ্রাচীনই নয়, সমৃদ্ধও বটে। এই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। জড়িয়ে আছে অদ্বৈতাচার্য্যের নামও। শান্তিপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে বাংলার প্রখ্যাত সব নাট্যব্যক্তিত্ব। অথচ শুধু মাত্র উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে শান্তিপুরের সেই সাংস্কৃতিক গৌরব আজ প্রশ্নের মুখে। এক সময় এই শহরের একাধিক নাটকের দল শান্তিপুরের পাশাপাশি সমৃদ্ধ করেছে বাংলার নাট্যজগৎকে।

শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরির সেই প্রেক্ষাগৃহ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরির সেই প্রেক্ষাগৃহ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

সুস্মিত হালদার
শান্তিপুর শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:২৩
Share: Save:

শান্তিপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস শুধু সুপ্রাচীনই নয়, সমৃদ্ধও বটে। এই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। জড়িয়ে আছে অদ্বৈতাচার্য্যের নামও। শান্তিপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে বাংলার প্রখ্যাত সব নাট্যব্যক্তিত্ব। অথচ শুধু মাত্র উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে শান্তিপুরের সেই সাংস্কৃতিক গৌরব আজ প্রশ্নের মুখে। এক সময় এই শহরের একাধিক নাটকের দল শান্তিপুরের পাশাপাশি সমৃদ্ধ করেছে বাংলার নাট্যজগৎকে। আর এখন সেই শান্তিপুরে মাত্র তিনটি নাটকের দল হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নাট্যচর্চার সেই ধারাকে কোনও রকমে টিঁকিয়ে রেখেছে।

শান্তিপুরে সেই অর্থে উপযুক্ত পরিকাঠামো-সহ কোনও প্রেক্ষাগৃহ নেই। সবেধন নীলমনি বলতে পাবলিক লাইব্রেরির একটি প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু সেই প্রেক্ষাগৃহের সামান্যতম পরিকাঠামোটুকুও নেই। সংস্কারের অভাবে জীর্ণ হয়ে পড়া ওই প্রেক্ষাগৃহের নড়বড়ে মঞ্চ, মলিন স্ক্রিন আর দেওয়াল থেকে খসে পড়া পলেস্তারা দেখলে প্রথম দর্শনে গুদাম বলেই মনে হয়। শহরের প্রবীণ নাট্যকর্মী পার্থসারথী চক্রবর্তী বলেন, “নাটক করার তেমন কোনও জায়গা নেই আমাদের এই শহরে। পাবলিক লাইব্রেরির যে প্রেক্ষাগৃহ আছে সেটাও নাটক করার উপযুক্ত নয়। এমনই নানা কারণে একের পর এক নাটকের দল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাত্র তিনটি দল এই মহূর্তে লড়াই করে কোনওমতে টিঁকে আছে।”

শহরের নাট্যকর্মীদের অভিযোগ, বহু বার স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে পুরসভার কাছেই অত্যাধুনিক না হোক ন্যূনতম পরিষেবা থাকবে এমন একটা প্রেক্ষাগৃহের দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। নতুন করে কোনও প্রেক্ষাগৃহ তো দূরের কথা, যে প্রেক্ষাগৃহটি আছে সেটাও উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে। বাধ্য হয়ে এই প্রেক্ষাগৃহেই প্রতি বছর নাট্যোৎসবের আয়োজন করতে বাধ্য হন উদ্যোক্তারা। সেখানেই কলকাতার পাশাপাশি ভিন্ রাজ্যের, এমনকী বাংলাদেশের নাটকের দল এসে নাটক মঞ্চস্থ করে যায়। দীর্ঘ দিন ধরে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে আসা ‘শান্তিপুর সাংস্কৃতিক’ এর কৌশিক চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শান্তিপুরের অভিনয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চৈতন্যদেব, অদ্বৈতাচার্য্যের নাম। অথচ সেই শহরে ন্যূনতম পরিকাঠামোযুক্ত একটা প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত নেই। এই মুহূর্তে আমরা যারা এখনও পর্যন্ত নাটকটা করছি তারাই কেবল বুঝতে পারছি যে সারা বছর ধারাবাহিক ভাবে নাটকটা চালু রাখা কত কঠিন কাজ। নাটকের একটা শো-এর আয়োজন করতে গিয়ে হিমসিম খেতে হয়। এ বার ভাবুন আস্ত একটা নাট্যোৎসব করতে গিয়ে আমাদের কী অবস্থা হয়!”

এই শহরের নাটকের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন নির্মলেন্দু লাহিড়ি, অবিনাশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো নাট্যব্যক্তিত্ব। এই শহরেই অভিনয় করে গিয়েছেন শিশির ভাদুড়ি, ছবি বিশ্বাস, উৎপল দত্তের মতো অভিনেতারা। পঞ্চাশের দশক থেকে শান্তিপুরের ‘শিল্পী মহল’, ‘ওপেন এয়ার’, ‘বৈশাখী ক্লাব’, ‘সরল স্মৃতি সঙ্ঘ’, ‘পদাতিক’, ‘প্রতিবাদী পদাতিক’, ‘লোকগীতি নাট্যম’, ‘শিল্পীলোক’, ‘আমরা সবাই’, ‘লংরুট’, ‘শ্যামবাজার যুব সঙ্ঘ’, ‘একতা নাট্যগোষ্ঠী’, ‘নবারুণ’ এর মতো একাধিক নাটকের দল বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে দাগ কেটেছিল। এদের কেউ কেউ আবার বামপন্থী আন্দোলনেও নিজেদের অবদান রেখে গিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এদের কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র ‘নবারুণ’ প্রতি বছর নাট্যোৎসবের আয়োজন করে।

শহরে ভাল কোনও প্রেক্ষাগৃহ না থাকা এবং সেই কারণে নাট্যচর্চার এমন অবস্থার জন্য সরাসরি পুরসভাকেই দায়ী করেছেন শহরের আর এক প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব মিন্টু মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “কোনও শহরের নাটক বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান শর্তই হল একটা ভাল প্রেক্ষাগৃহ। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের পুরসভা এখনও পর্যন্ত একটা প্রেক্ষাগৃহই তৈরি করতে পারল না। পুরসভার এই ব্যর্থতার দায় বহন করতে হচ্ছে এই শহরের মানুষ ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের।” তিনি বলেন, “সেই কবে একটা প্রেক্ষাগৃহ তৈরি হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত যার কোনও সংস্কার কিংবা আধুনিকীকরণ হল না। ভাবতে অবাক লাগে কোনও রকম সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো ছাড়াই একটা শহর কী ভাবে বেড়ে উঠছে। জানি না আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা কী রেখে যাচ্ছি!”

শান্তিপুরের পুরপ্রধান তথা তৃণমূলের বিধায়ক অজয় দে বলেন, “একটা উন্নত মানের আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ তৈরির জন্য আমরা একাধিকবার উদ্যোগী হয়েছি। কিন্তু শহরের ভিতরে উপযুক্ত জায়গার অভাবে আমরা সেটা করে উঠতে পারছি না। সেই কারণে আমরা পাবলিক লাইব্রেরির প্রেক্ষাগৃহটিকেই আধুনিকীকরণের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছি। পূর্ত দফতরের কর্তারা এসে প্রেক্ষাগৃহটিকে সরেজমিনে দেখেও গিয়েছেন। আশা করছি, এ বার আমরা শহরের সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটা আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ উপহার দিতে পারব।” জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক মৃত্যুঞ্জয় মিত্র বলেন, “শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরির প্রেক্ষাগৃহটি আধুনিকীকরণ করা হবে। সেই মতো পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।”

রয়েছে আর একটি সমস্যাও। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আর আগের মতো নাটকে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। সম্প্রতি পুরসভা শহরের ১৪টি হাই স্কুলের মধ্যে চালু করেছে আন্তঃবিদ্যালয় নাট্যোৎসব। স্কুল স্তরে এই নাট্যচর্চার মাধ্যমেই আগামী প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে করছে শান্তিপুর।

কেমন লাগছে আমার শহর? আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান
district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’,
নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

susmit halder shantipur amar sohor auditorium
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE