Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

পুরসভায় ‘দুয়োরানি’ রানাঘাট পূর্বপাড়

রানাঘাট পুরসভা গঠিত হয়েছিল ১৮৬৪ সালে। তারও দু’বছর আগে রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেলপথ চালু করে ব্রিটিশ সরকার। পুরসভা গঠনের পর দেখা যায় শহরকে পূর্ব পশ্চিমে ভাগ করে দিয়েছে রেল। বঞ্চনার শুরু তখন থেকেই। শহরের বড় অংশ পশ্চিমে থাকায় সেই অংশে উন্নয়ন ঘটলেও পূর্ব দিকে সেই অর্থে কোনও উন্নয়ন ঘটেনি। রাস্তাঘাটও সেভাবে গড়ে ওঠেনি।

পূর্বপাড়ের মনসাতলাপাড়ার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছড়িয়ে রয়েছে আবর্জনা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

পূর্বপাড়ের মনসাতলাপাড়ার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছড়িয়ে রয়েছে আবর্জনা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

সৌমিত্র সিকদার
রানাঘাট শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৩৯
Share: Save:

রানাঘাট পুরসভা গঠিত হয়েছিল ১৮৬৪ সালে। তারও দু’বছর আগে রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেলপথ চালু করে ব্রিটিশ সরকার। পুরসভা গঠনের পর দেখা যায় শহরকে পূর্ব পশ্চিমে ভাগ করে দিয়েছে রেল। বঞ্চনার শুরু তখন থেকেই। শহরের বড় অংশ পশ্চিমে থাকায় সেই অংশে উন্নয়ন ঘটলেও পূর্ব দিকে সেই অর্থে কোনও উন্নয়ন ঘটেনি। রাস্তাঘাটও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। রয়েছে পানীয় জলের সমস্যাও। এখনও পর্যন্ত সব জায়গায় বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবি একটি সাবওয়ের। সেই কাজ শুরু হলেও রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, সাবওয়ে নয়, যাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা। যা নিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই পূর্বপাড়ের বাসিন্দাদের।

১৯ আসন বিশিষ্ট রানাঘাট পুরসভার ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯ ওয়ার্ড এবং ৫ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু অংশ রয়েছে পূর্বপাড়ে। কুপার্স ক্যাম্প নোটিফায়েড এবং নোকারি ও শ্যামনগর গ্রাম পঞ্চায়েত পড়ছে পূর্বপাড়ে। এক সময় বাংলাদেশের যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, নওয়াখালি-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার-হাজার মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বাদল চক্রবর্তী জানান, সেই সময় পূর্বপাড়ে জমির দাম কম ছিল। তাই, বাংলাদেশের থেকে আসা মানুষ এখানে বসবাস শুরু করেছিলেন। তবে, বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও ওই এলাকায় সেভাবে উন্নয়ন হয়নি। সব রাস্তায় বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি।

ওই এলাকার মানুষ পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য রেল কর্তৃপক্ষের কাছে সাবওয়ে তৈরির দাবি জানিয়ে এসেছেন। রেল স্টেশনের দু’দিকে বেশ খানিকটা দূরে রয়েছে চাবিগেট এবং রথতলা গেট। এই রেল পথ দিয়ে গেদে, শান্তিপুর, লালগোলা, বনগাঁ এবং কৃষ্ণনগরগামী ট্রেন চলাচল করে। এছাড়াও মাঝে মাঝেই মালগাড়ি বাংলাদেশে যায়। তাই একবার গেট পড়লে রেল লাইন পার হওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কখনও কখনও তা আধ ঘন্টার উপর গেট পড়ে থাকে, ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়।

কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় মুকুল রায় একটি সাবওয়ের শিলান্যাস করেছিলেন। কাজ শুরুও হয়েছে। কিন্তু সেই সাবওয়ে দিয়ে শুধু পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করা যাবে, গাড়ি নিয়ে নয়। ফলে পূর্বপাড়ের মানুষের খুব একটা উপকারে লাগবে না বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি। রানাঘাট নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রমোদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এখানে সাবওয়ে তৈরির কথা ছিল ২০১০ সালে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রী-এর শিলান্যাস করেন। ২০১৪ সালে কাজও শুরু হয়। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে ওই রাস্তা শুধু পথচারীদের জন্য। কোনও গাড়ি যেতে পারবে না। যে উদ্দেশে আমাদের লড়াই সেই দাবিটাই পূরণ হল না। এর ফলে, ওপারের মানুষের সেই অর্থে কোনও কাজে আসবে না। জায়গাটা সমাজবিরোধীদের আখড়ায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।” স্থানীয় বাসিন্দাদের আবেদন সেখান দিয়ে একটা ছোট গাড়ি বা রোগীদের বহণ করার জন্য যাতে অ্যাম্বুলেন্স চলতে পারে, তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।

রানাঘাটের পুরপ্রধান ও বিধায়ক পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সাবওয়ে তৈরির জন্য শিলান্যাস করা হয়েছিল। পরে কংগ্রেসের রেলমন্ত্রী হওয়ার পর ওই প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন যা হতে চলেছে, তা সমাজবিরোধীদেরই কাজে বেশি লাগবে। সাধারণ মানুষের কোনও উপকার হবে না।” অন্য দিকে, জেলা কংগ্রেস সভাপতি অসীম সাহা বলেন, “তৃণমূল ওখানে যা করেছিল, সেই মতো কাজ হচ্ছে। অধীর চৌধুরী রেলমন্ত্রী হয়েও ওই প্রকল্পের কোনও পরিবর্তন করেননি। রাজনৈতিক উদ্দেশে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে।”

এক সময় সেনাবাহিনীর কাজ শেষ করে রেলে চাকুরিতে যোগ দিয়েছিলেন পঞ্জাবের বাসিন্দা হরবনস সিংহ। রানাঘাটের মেয়েকে বিয়ে করে শহরেই থেকে গিয়েছেন। তিনি বলেন, “উন্নয়ন হলেও পশ্চিমপাড়ের মতো কিছুই হয়নি। ভাল বাজার, স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নার্সিংহোম সব কিছুই ওপারে। কিন্তু সাবওয়ে না থাকায় ওপারে যাওয়াটাই সবচেয়ে মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা গৃহবধূ ময়না বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সাবওয়ে না থাকার জন্য সবচেয়ে সমস্যা প্রসুতি মায়েদের। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সময় অনেকেই রাস্তায় প্রসব করেন।”

রানাঘাট পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের শীতলাতলা মোড়ের ব্যবসায়ী রতন দাস বলেন, “এই এলাকায় এখনও নর্দমা তৈরি হয়নি। যার কারণে একটু বৃষ্টি হলেই জল জমে যায়। সেই সময় চলাফেরা করাই দায় হয়ে পড়ে। এছাড়াই এখানে পাকা রাস্তা তৈরি হয়নি। মনেই হয় না এলাকাটি পুরসভার অন্তর্ভুক্ত। ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সাধুরবাগান বাসিন্দা গৃহবধূ সুনু বিবি বলেন, “এলাকায় এখনও নলবাহিত জলের পরিষেবা নেই। যার কারণে দূর থেকে জল নিয়ে আসতে হয় কমবেশি একশোটি পরিবারকে। এই সমস্যার শিকার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের আমতলার বাসিন্দা রতন ঘোষ বলেন, “এই এলাকায় নর্দমা আছে কিন্তু, নিয়মিত সেই নর্দমা পরিষ্কার করা হয় না। ফলে মশার উপদ্রব হয়।”

যদিও তা মানতে চাননি পুর-প্রধান তৃণমূলের পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এক সময় পূর্বপাড়ের বেশির ভাগ অংশ ছিল উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের অধীনে। সেই কারণেই, ওই এলাকা বেশ কয়েক বছর পরে পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে, তাঁরা বঞ্চিত, একথা বলা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না।” তিনি বলেন, “পানীয় জল নিয়ে একটা সমস্যা রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে। ভাগিরথী নদী থেকে জল নিয়ে এসে তা পরিস্রুত করে শহর জুড়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে।”

পুরসভার পশ্চিম পাড়েও রয়েছে সমস্যা। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নাসড়াপাড়ার বাসিন্দা কোহিনুর বিবি বলেন, “বাড়িতে জলের লাইন নেওয়ার জন্য বছর তিনেক আগে পুরসাভায় আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু, আজও তা চালু হয়নি।” গৃহবধূ বাসন্তী দাস বলেন, “বাড়িতে জলের লাইন থেকেও শান্তি নেই। পানের অযোগ্য জল আসে। বাসন মাজা ছাড়া অন্য কোনও কাজ করা যায় না। নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। জল ঠিকমতো গড়ায় না। সর্বত্র ময়লা ফেলার কোনও জায়গা নেই। বৃষ্টি হলে বিভিন্ন জায়গায় জল জমে যায়। রাস্তা ঠিকমতো সংস্কার করা হয় না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shahar amar sohor ranaghat soumitra sikdar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE