Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাজার নিয়ে নাজেহাল বেলডাঙা, উদাসীন পুরসভা

দক্ষিণ থেকে উত্তরে মুর্শিদাবাদ জেলাকে দেখা হলে বেলডাঙা শহরের অবস্থান একেবারে দক্ষিণে। বেলডাঙা মানেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতি, বেলডাঙায় ব্রিটিশ আমলে তৈরী চিনি মিল, মনোহারা, গামছা, কাঁচা লঙ্কা আর কার্তিক লড়াইকে বোঝেন এলাকার মানুষ। সারা বাংলা বেলডাঙাকে চেনে তার শতাব্দী প্রাচীন বড়ুয়া পশুহাট ও সংলগ্ন বাজারের জন্য।

ঘিঞ্জি রেল বাজার।

ঘিঞ্জি রেল বাজার।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
বেলডাঙা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:১৫
Share: Save:

দক্ষিণ থেকে উত্তরে মুর্শিদাবাদ জেলাকে দেখা হলে বেলডাঙা শহরের অবস্থান একেবারে দক্ষিণে। বেলডাঙা মানেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতি, বেলডাঙায় ব্রিটিশ আমলে তৈরী চিনি মিল, মনোহারা, গামছা, কাঁচা লঙ্কা আর কার্তিক লড়াইকে বোঝেন এলাকার মানুষ। সারা বাংলা বেলডাঙাকে চেনে তার শতাব্দী প্রাচীন বড়ুয়া পশুহাট ও সংলগ্ন বাজারের জন্য। বেলডাঙা অহল্যা লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের প্রধান সম্পাদক ও লোকসংস্কৃতির গবেষক সন্তোষরঞ্জন দাস বলেন, “পুরনো নথিপত্র থেকে জানা গিয়েছে বড়ুয়া বাজারের বয়স আনুমানিক ৫০০ বছর। বাংলায় বর্গী আক্রমণের আগেও বড়ুয়ার নাম পাওয়া যায়। বড়ুয়ার পাশের একটি জনপদের নাম ছিল হিঙ্গলবাড়ি মৌজা। সেই মৌজার নাম এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে।”

বেলডাঙা জেলার মধ্যে অন্যতম বড় বাণিজ্য কেন্দ্র। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভাগীরথী। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক, রেলপথ। নওদা ও হরিহরপাড়া এলাকায় রেলপথ না থাকায় ওই ব্লকের কয়েক লক্ষ মানুষের কলকাতা যাতায়াতের জন্য বেলডাঙাতে আসেন। তারও একটা বড় প্রভাব পড়ে বেলডাঙা বাজারে। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও পরিকাঠামোর দিক থেকে বেলডাঙা বাজারের উন্নতি তো হয়ইনি বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেহাল হয়ে পড়েছে এই বাজার। বেলডাঙার যে হাটের কথা জানেন রাজ্যের মানুষ, যে হাটে ফি সপ্তাহে কয়েক কোটি টাকার বেচাকেনা হয়, সেই হাটের হতশ্রী চেহারা দেখলে অবাক হতে হয়। বড়ুয়ার ওই পশু হাট লাগোয়া সব্জি ও কাপড়ের হাটের অবস্থাও তথৈবচ। সেখানে মাথার উপরে কোনও ছাউনি নেই, স্থায়ী ছাদ নেই, নেই চলাচলের উপযুক্ত রাস্তাও। কোনও নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় জল জমে যায়। সেখানে বসতে না পেরে জাতীয় সড়কের দু’পাশে বসে ব্যবসা করেন ব্যবসায়ীরা। রাস্তায় তিল ধারনের জায়গা থাকে না। ফলে ওই চত্বরে ছোটখাটো দুর্ঘটনা লেগেই থাকে।

বড়ুয়া বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী ইয়াকুব হোসেন জানান, বাপ-ঠাকুর্দার মুখে তিনি শুনেছেন, এই হাট একশো বছরেরও বেশি পুরনো। আগে এখানে ঘোড়া, উট, গরু, মোষ, ছাগল, হাঁস, মুরগি, বিক্রি হত। এখন ছাগল, গরু, মোষ ছাড়া আর কিছু বিক্রি হয় না। প্রতি মঙ্গলবারে এই হাট বসে। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও নদিয়া, বীরভূম, মালদহ ও বধর্মান থেকে ব্যবসায়ীরা এই হাটে আসেন। সোমবার রাতে দূরদুরান্তের ব্যবসায়ীরা শহরে এসে ভাড়া বাড়ি অথবা হোটেলে থেকে পরের দিন ব্যবসা করে বাড়ি ফেরেন। বেলডাঙার অর্থনীতিতে এই হাটের বিরাট প্রভাব রয়েছে। অথচ এই হাটের বিষয়ে প্রশাসন থেকে পুরসভা সকলেই উদাসীন। ওই হাটের আর এক ব্যবসায়ী জাফর শেখ বলেন, “সামান্য বৃষ্টিতেই হাটে জল জমে যায়। তখন ওখানে বসে আর ব্যবসা করা যায় না। অগত্যা রাস্তাতেই বসতে হয়। সেখানেও রয়েছে হাজার ঝামেলা।”

হাট বাদ দিয়েও বেলডাঙার অন্যতম বড় বাজার বসে বড়ুয়াতেই। সেখানে ফল, সব্জি, মাছ-মাংস সবই পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানেও রয়েছে নানা সমস্যা। আবর্জনায় ভরা ওই বাজারে বাজার করতে গিয়ে হাঁফিয়ে ওঠেন শহরের মানুষ। বেলডাঙা ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নূরজাহান বিবি বলেন, “ওই বাজারে এত নোংরা ও আবর্জনা ছড়িয়ে থাকে যে বাজারে যাওয়াটাই একটা আতঙ্কের মতো। তার উপরে ওই বাজারের মধ্যে দিয়েই চলে গিয়েছে বেলডাঙা থেকে আমতলা যাওয়ার রাস্তা। পাশেই ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। বাসগুলো যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফলে ভিড়, যানজট, নোংরা সবমিলিয়ে সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি হয়। পুরসভা এবং ব্যবসায়ী সমিতি যদি পদক্ষেপ করে, উপকৃত হয় সারা শহর।”


এমনই দশা বড়ুয়া পশুহাটের।

বড়ুয়া ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক মুকতাদির হোসেন বলেন, “এ বিষয়ে পুরসভাকে স্মারকলিপি দিয়েছি, আন্দোলন করেছি। কিন্তু কোনও কাজ না হওয়ায় আমরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ৭০ জন কর্মীকে নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁরা বাজারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় দেখভালের পাশাপাশি অন্যান্য কাজও করে। এর ফলে চুরি-ছিনতাই কমলেও বাজারে আবজর্নার সমস্যা থেকেই গিয়েছে। প্রশাসনিক সামান্য সাহায্য পেলেও সমস্যা অনেকটাই মেটানো যেত। নিকাশি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি ভাবে একটি ড্রেন তৈরিও শুরু হয়েছিল। কিন্তু জায়গা-জটে তা এখন বিশ বাঁও জলে।” ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ক্রেতাদের পাশাপাশি বিক্রেতাদের ভোগান্তিও কিছু কম নয়। বাজারে কোনও শৌচাগার নেই, নেই পানীয় জলের ব্যবস্থাও।

বড়ুয়ার ব্যবসায়ীদের আক্ষেপ, “বেলডাঙা বাজার মানে বেশিরভাগ লোকজন এই বড়ুয়া বাজারকেই বোঝেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে এই বাজারের পরিকাঠামোগত কোনও উন্নতি না হওয়ায় শহরের মানুষ আস্তে আস্তে এই বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ক্রেতারা চলে যাচ্ছেন বড়ুয়া থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পাঁচরাহা ও ছাপাখানা বাজারে।” স্থানীয় নাট্য পরিচালক প্রদ্যুৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরে যে ভাবে জনসংখ্যা, দোকানপাট, যানবাহন বেড়েছে সেই অনুপাতে পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি হয়নি। আর তার ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে।”

বেলডাঙা পুরসভার পুরপ্রধান কংগ্রেসের অনুপমা সরকার বলেন, “বাজারের হাল ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। শহরে ভাল রাস্তা ও আলোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তবে বিরোধী কাউন্সিলররা বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা করে পদে পদে সমস্যা তৈরী করায় ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছুই ঠিকভাবে করা যাচ্ছে না।” পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী সিপিএমের শীলা ঘোষ বলেন, “উন্নয়নের ব্যাপারে পুরবোর্ডের সঙ্গে আমাদের কোনও বিরোধ নেই। তবে শহরের বাজার ও বেশ কিছু সমস্যার বিষয়ে আমরা বোর্ড মিটিংয়ে বলেছিলাম। কিন্তু সেগুলোকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।” রাজনৈতিক এই চাপানউতোর নয়, বেলডাঙা চায় শহরের উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করুক সব দল।

—নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE