Advertisement
E-Paper

বালুচরি কার, জমাট বিতর্ক পত্রিকার শারদ সংখ্যায়

বালুচরি শাড়ি নিয়ে বিষ্ণুপুর আর মুর্শিদাবাদের বালুচরের মধ্যে ‘পেটেন্ট’ দাবি করে আজও আইন-আদালত হয়নি ঠিকই। তাই বলে দু’তরফের মধ্যে ‘ঝগড়া’ বড় কম নয়। বালুচরি শাড়ি কার? জিয়াগঞ্জের, নাকি বিষ্ণপুরের? সে নিয়ে আজও তুফান ওঠে চায়ের কাপে।

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৫ ০১:০৬

বালুচরি শাড়ি নিয়ে বিষ্ণুপুর আর মুর্শিদাবাদের বালুচরের মধ্যে ‘পেটেন্ট’ দাবি করে আজও আইন-আদালত হয়নি ঠিকই। তাই বলে দু’তরফের মধ্যে ‘ঝগড়া’ বড় কম নয়। বালুচরি শাড়ি কার? জিয়াগঞ্জের, নাকি বিষ্ণপুরের? সে নিয়ে আজও তুফান ওঠে চায়ের কাপে।

কারণ, জিয়াগঞ্জের আদি নাম যে বালুচর। সেই বিতর্কে যুক্তি সাজিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট লেখক-গায়ক-অভিনেতা-বাচিকশিল্পী তথা ভাষ্যকার তরুণ চক্রবর্তী। তরুণবাবু একা নন, সম্প্রতি ‘অনুভব’ পত্রিকার শারদ সংখ্যার অনুষ্ঠানিক প্রকাশ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বালুচরি ও বালুচর বির্তকে সামিল হয়েছেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক মানবেন্দ্রনাথ সাহা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক জহরসেন মজুমদার-সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই।

সমীর ঘোয সম্পাদিত জিয়াগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘অনুভব’ পত্রিকার এ বারের শারদসংখ্যার বিষয়ঃ বালুচর ও বালুচরি। সেখানে তরুণবাবু তাঁর নিবন্ধ ‘বালুচরির বেলাভূমিতে’ লিখেছেন, ‘নিশ্চয় কোনও বড় ঘরের বউ হবে। যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি ওই শাড়ির রঙের বাহার। এমন নকশার কাজ আর পিঠের আঁচল, না অক্ষয় দাস কেন, তল্লাটের আর কেউ কখনও দেখেছে কি? তিনি এক জায়গায় ঠাঁই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করলেন। পরে খোঁজ খবর নিয়ে জানলেন সে মেয়ের বাড়ি মুর্শিদাবাদে। সুন্দরী সেই মহিলার টানে নয়, তাঁর অঙ্গের ওই শাড়ির
টানেই সুদূর বিষ্ণুপুর থেকে কখনও হেঁটে কখনও গাড়িতে করে মুর্শিদাবাদের বালুচরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি একদিন। জেনেছিলেন সে শাড়ির নাম বালুচরি, কিন্তু তার বয়ন পদ্ধতি তিনি শেখে নেবেন, এমন শিল্পীর দেখা পাননি।’

তিনি লিখছেন, ‘এক সময় সুযোগ হল বিশিষ্ট শিল্পরসিক সুভো ঠাকুরের ব্যক্তিগত সংগ্রহের পুরনো একটি বালুচরি শাড়ি দেখার। সেটি দেখে অক্ষয়বাবু বুনে ফেললেন একখানি বালুচরি শাড়ি। গাণিতিক জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন বালুচরির সূক্ষ্ণ ও জটিল নকশাকে জ্যাকার্ডে রূপান্তরিত করতে। সন্দেহ নেই বালুচরির জন্ম মুর্শিদাবাদের বালুচরেই... পরবর্তীকালে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে এর নবজন্ম বলা যেতে পারে।’’ ওই শারদসংখ্যায় একই মত ব্যক্ত হয়েছে বালুচরের ভূমিপুত্র প্রয়াত নট ও নাট্যকার প্রয়াত বিধায়ক ভট্টাচার্য ও প্রয়াত সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের পুর্ণমূদ্রিত লেখায়।

ওই সংখ্যায় বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রকাশ দাস বিশ্বাস তাঁর লেখা ‘বালুচর, বালুচরি এবং বালুচরের বয়নশিল্পীরা’ শীর্ষক প্রবন্ধে জিয়াগঞ্জের পক্ষে মত বুনেছেন। সাহায্য নিয়েছেন ১৭৪২ সালে জিয়াগঞ্জের বালুচরে বর্গি হামলার মতো ঐতিহাসিক ঘটনার। ১৭৫৫ সালে বঙ্গদেশে ডাচ ফ্যাক্টরি সমূহের ডিরেক্টর টেলিফোর্ডের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তির। এবং ১৮৫৭ সালে ভারত পথিক যদুনাথ সর্বাধিকারীর লেখার। প্রকাশ লিখেছেন, যদুনাথ সর্বাধিকারী তাঁর ভারত ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ২১ কার্তিক জিয়াগঞ্জে এসেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রাতে গয়সাবাদ হইতে রওনা হইয়া ২ ক্রোশ আসিয়া মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ। এই বাজারে লবন, তুলোর গোলা। পরে বালুচর, এখানে চেলি গরদের আড়ত।’

বিশিষ্ট সঙ্গীত গবেষক তথা প্রাবন্ধিক রমাপ্রসাদ ভাস্কর তাঁর ‘রেশম শিল্পের অনন্য অধ্যায়ঃ বালুচরের বিস্ময়কর বালুচরি’ নিবন্ধে জিয়াগঞ্জের বালুচর ও বালুচরির পক্ষে স্বাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ হিসেবে নিয়েছেন ‘দি জার্নাল অব ইন্ডিয়া আর্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’তে প্রকাশিত নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘দি সিল্ক ইন্ডাসট্রিজ অব মুর্শিদাবাদ’ এবং বিনয় ঘোষের লেখা ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’র তৃতীয় খণ্ডের। বিনয় ঘোষ, নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়, ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘মহারাজাকৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’ গ্রন্থের তথ্যও বলছে, বালুচরি শাড়ির আদি স্রষ্টা জিয়াগঞ্জের বালুচর। জিয়াগঞ্জ লাগোয়া বাহাদুরপুর গ্রামের বালুচরি শাড়ির ভুবনখ্যাত শিল্পী দুবরাজ দাসের সম্পর্কে বিনয় ঘোয তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’র গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে বর্ণনা করেছেন।

ওই গ্রন্থের সমর্থনে রমাপ্রসাদ ভাস্কর লিখেছেন, ১৯০০ সালে ৭৮ বছরের বৃদ্ধ দুবরাজের বোনা বালুচরি শাড়ি, স্কার্ফ, টেবিল ক্লথ ও নামাবলি প্যারিসের বিশ্বমেলায় ‘ডিপ্লোমা অব অনার’ ও স্বর্ণপদক লাভ করে। ফের ১৯০৬ সালে ৮৪ বছরের বৃদ্ধ বালুচরি শিল্পী দুবরাজ লন্ডনের বিশ্বমেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। দেওয়া হয় স্বর্ণপদক ও ‘সার্টিফিকেট অব অনার’। ১৯৮২ সালের ১৬ অক্টোবরের ‘দেশ’ পত্রিকায় ভুবনভুলানো বালুচরি শাড়ির বয়ন কৌশল ও নকশা সম্পর্কে চিত্রা দেব ‘স্বপ্নালোকোর বালুচরি’ নিবন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। ওই নিবন্ধেই তিনি লিখেছেন, বালুচরী শাড়ির অলংকরণকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে— চিত্র, কল্কা, পাড় ও বুটি। এদের মধ্যে ‘চিত্র’ নকশায় বেশি কৌতূহলোদ্দীপক যা অন্য শাড়িতে দুর্লভ।

বিলেতের শিল্পবিপ্লব ও ইংরেজ বণিকের মাণদন্ড রাজদণ্ডে পরিণত হওয়ায় সেই ভবনমোহিনী বালুচরী আজ আক্ষরিক অর্থেই মুর্শিদাবাদে দুর্লভ। বালুচরি শাড়ির সঙ্গে ভাগীরথী গর্ভে বিলীন হয়ে বালুচর আজ কেবল অতীত ঐতিহ্যের ইতিহাস মাত্র।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy