Advertisement
E-Paper

সিঁদুরের ঠাট্টা সয়ে একার লড়াই

এ গাঁয়ে যে পুজো হয়, প্রথমটা বিশ্বাসই হয়নি দীপালির। সন্ধে হতে না-হতেই যেখানে গুলিগোলা, লুঠপাটের ভয়ে ঘরে সেঁধিয়ে থাকা, সেখানে আবার পুজো!

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:৩৮

এ গাঁয়ে যে পুজো হয়, প্রথমটা বিশ্বাসই হয়নি দীপালির।

সন্ধে হতে না-হতেই যেখানে গুলিগোলা, লুঠপাটের ভয়ে ঘরে সেঁধিয়ে থাকা, সেখানে আবার পুজো!

তার পর দীপালি দেখলেন, এ গাঁয়েও নেমে আসে আশ্বিনের শারদ-সকাল। সারা বছরের ছবিটা পুজোর ক’দিন সত্যিই পাল্টে যায়। তখন বিএসএফের চোখরাঙানি বন্ধ। গুলির শব্দ নেই। রাত ১০টা-১১টা অবধি পিচরাস্তায় ভিড়। আশপাশের গাঁ, ‘ও-পার’ থেকেও মেলা লোক জড়ো হয় এই মহাখোলায়। এখানে একটাই পুজো। হাটবারে হাট বসে যে মাঠে, সেখানেই প্যান্ডেল! ফুচকা-চাউমিন-এগরোল-অর্কেস্ট্রায় জমজমাট।

মানুষটা তবু বলত, এখানে নয়। চলো কৃষ্ণনগর ঘুরে আসি! বগুলায় বাপের বাড়িতে থাকবে তো একটু! বাদকুল্লার পুজো এক বার দেখবে না দীপা? হাবভাব দেখে কে বলবে, প্রায় সতেরো বছরের বড় স্বামী!

আরব না কোথায় চাকরি করে পাত্র! তাই মাধ্যমিক দেওয়ার আগেই বিয়েটা মিটে গিয়েছিল। ভীষণ মিশুকে একটা লোক। সব সময়ে মনে ফুর্তি।

দু’-তিন বছর অন্তর মানুষটা ঘরে ফিরলে উত্সব লেগে যেত। দুবাইয়ের পরে চাকরি হল ইরাকের মসুলে। মাসে প্রায় হাজার তিরিশ বেতন। কাঠের কাজে এত টাকা কে দেবে এ দেশে? তখন ও থাকলে রোজই ভাল-মন্দ ভোজ। ঝাল-মশলা দিয়ে কষানো দেশি মুরগি-খাসি, বড় মাছ, রাজ্যের পিঠে-পুলি— কিছু বাদ নেই। ও বলত, ‘‘ও-দেশে সবকিছুই কেমন টক-টক রান্না, খেয়ে সুখ নেই ধুর!’’

ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে কত কী যে করতে হতো। সে-বারও বকেঝকে পার্লারে পাঠাল। ভুরু ঠিক করো, চুল সেট করো! বউ সব সময়ে টিপটপ থাকবে, এটাই শখ লোকটার। ২০১৩-র জুলাই না অগস্ট সেটা। ১৯ দিনের জন্য এসেছিল। সেই শেষ বার!

এখন ইচ্ছেই করে না ঘর ছেড়ে বাইরে পা রাখতে। নিজের মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করে না। মাটির ঘরখানায় ঝালর দেওয়া ড্রেসিং টেবিলে আয়নাই নেই আজ ক-ত দিন। ধুলো জমছে আয়নার পাশে তাকে রাখা বাঁধানো ছবির ফ্রেমে। বগুলার স্টুডিওয় বসে কুচকুচে কালো চুল, মোটা গোঁফের হাট্টাকাট্টা মানুষ। তার গা ঘেঁষে ঝুঁকে গোলগাল স্বামীসোহাগিনী। ছবির মেয়েটাকে অচেনা লাগে দীপার। দেড় বছরে চেহারা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে সমর টিকাদারের ঘরণীর। জামা সব ‘ঢিলা’ হয় এখন।

হঠাত্ বেতালা হয়ে গেল জীবনটা। ছ’বছরের মামণি খালি জেদ ধরে, বাপিকে ‘মিস্‌ কল’ দাও মা! বাপি কেন কথা বলে না আমার সঙ্গে? ক্লাস সেভেনে উঠে ছেলেটাও চুপ মেরে গিয়েছে। মামার বাড়ি থেকে ইস্কুল যায়। বাবার কথা আর মুখে আনে না।

পাশের বাড়িতে বড় নন্দাই আদিত্য বিশ্বাস থেকে থেকে বলেন, ‘‘আর কি ফিরবে সমর! কে জানে বেঁচে আছে কি না!’’ ফিসফাসে কান দেন না দীপালি। বাস-ট্রেন উজিয়ে কদাচিত্ বাপের বাড়ি বা কল্যাণীতে বড় ডাক্তার দেখাতে গেলে আগের মতোই চূড়া-করা স্টাইলে চুল বেঁধে নেন। ডান দিক ঘেঁষা চিলতে সিঁথিতে ছোট্ট কপালটা ছুঁয়ে সিঁদুরের রেখা।

সিঁদুর পরার সময়ে মনে হয়, সেই রেখাই যেন হাজার হাজার মাইল, সাগর-পাহাড় পেরিয়ে উড়োজাহাজের মতো উড়ে যাচ্ছে কোন দূর দেশে। নদিয়ার চাপড়া ব্লকের এই ‘বর্ডার এরিয়া’র থেকেও ঢের গোলমেলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সে দেশ। ফোনে কথা বলার সময়ে ‘ও’ এক দিন বলেছিল, ‘‘বাইরে শুনতে পাচ্ছ গুলি-বোমার আওয়াজ। ভয় নেই, আমরা সব ঠিক আছি!’’

গুলি তো এখানেও চলে আকছার। বিকেল পাঁচটার পরে আর পিচরাস্তায় ওঠা যায় না। বিএসএফের নিষেধ। এ ঘরখানা ছেড়ে পুঁচকে মেয়েটাকে নিয়ে উঠোনের তুলসীমঞ্চে যেতেও বুক কাঁপে একলা মেয়েমানুষের! উঠোন পেরিয়ে লতা-ঢাকা একটা বিল। ও-পারে খেজুর গাছের পিছনেই মুন্সিপুর। কুষ্ঠিয়া, বাংলাদেশ। সন্ধেয় ঘরে বসেই বোঝা যায়, কারা যেন ও দিক থেকে ঢুকছে। কখনও বা গরুর পাল, এই উঠোন পেরিয়েই ও-পারে যায়! সকাল হতে কোনওদিন খবর আসে, পিচরাস্তায় কাদের যেন গুলিতে পেড়ে ফেলা হয়েছে।

কালেভদ্রে ছুটিতে দেশে-আসা স্বামীর দাম্পত্যের খাটে ঢিকিস-ঢিকিস লো-ভোল্টেজ পাখা চলে। ঘরণী বলেন, বিশ্বাস করুন, ‘‘ও কতটা বিপদের মধ্যে আছে, কিছুই বুঝিনি।’’

মাঝে দু’দিন ফোন নেই। এক রাতে মিস্‌ড কল দিতেই সমর স্ত্রীকে ফোন করেন, ‘‘খুব গোলমাল, বেরোতে পারছি না। পয়সাও বেশি ভরা নেই।’’ তখন ফোন কেটে দীপাই ফোন করেন। পরের দিন, ২০১৪-র ১৪ জুলাই, শেষ বার কথা। সমর বলেছিলেন, ‘‘চিন্তা কোরো না! তালিবান আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। সুযোগ পেলে ফোন করব।’’

হ্যাঁ, তালিবানই বলেছিল ‘ও’। তার পর শোনা গেল ‘আইএস’ জঙ্গিরা নাকি নিয়ে গিয়েছে ওদের। ‘ইসলামিক স্টেট’। দীপার স্বামীর দৌলতে নতুন শব্দবন্ধ অধুনা ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতের প্রান্তিক গ্রামে।

পাশের তেহট্টের ইলশামারি গ্রাম থেকে নমিতাদির ফোন আসে। খোকন সিকদারের স্ত্রী নমিতা সিকদার। সমর ষখন শেষ বার আসেন, বগুলায় গিয়ে দেখা করে তাঁর হাতে স্বামীর জন্য কিছু ওষুধ, জামাকাপড় দিয়ে এসেছিলেন নমিতা। মসুলেই এক জায়গায় ছিলেন খোকন। তখন কে জানত, দুই নারীর ভাগ্য বাঁধা পড়ে যাবে এক সুতোয়।

নমিতার মেয়ে বড়, ছেলে কোলের। দীপাকে ফোনে বলেন, ‘‘একটা বৌ বলছিল, ইরাকে নাকি জনা ৪০ এক সঙ্গে মুক্তি পেয়েছে। শুনেছ কিছু?’’ দীপা আমতা-আমতা করেন, ‘‘ভাই বলছিল, কোন কাগজে বেরিয়েছে, ইরাকের পাশে সিরিয়া না-কোথা থেকে এক জন পালিয়ে দেশে ফিরেছে!’’ অলীক আশা ঘুরপাক খায়। দু’জনেই দু’জনকে বোঝান, হয়তো মোবাইলটা কেড়ে নিয়েছে, অসুবিধেয় আছে। কিন্তু ঘরের লোক ঠিক ফিরবে একদিন।

কোনও মতে ইস্কুলের গণ্ডি ছোঁয়া দুই পাড়াগেঁয়ে নারী একসঙ্গে কৃষ্ণনগরে ডিএম বাংলোয় যান, নবান্নে চিঠি লেখান, কলকাতায় বিজেপি অফিসে গিয়ে হদিস নেন, কী করে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের দেখা মিলবে। ইরাকের মসুলে তারিক নুর আল হুদা কোম্পানির ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন পঞ্জাবি। বাংলার এই দু’জন! অন্য যাঁদের খোঁজ নেই, তাঁদের অনেকের আত্মীয়রা দিল্লিতে দরবার করেছেন। মন্ত্রীর আশ্বাস, সংসদে হইচই কবেই বাসি হয়েছে। যুদ্ধ থামেনি। জীবনও।

দীপা ভাবেন, লোকটা আগে ১৬-১৭ বছর দুবাইয়ে থেকেছে। ইরাক যে ঝামেলার দেশ, তা কি ও জানত না? নমিতার স্বামী আগে এক বার মালয়েশিয়ায় ছিলেন। শখ ছিল, স্বাধীন ভাবে কাঠের আসবাবের কাজ করবেন একদিন। তাই ধারধোর করে জেদের বশেই ইরাক পাড়ি। আরব, দুবাই, মাসকট, কাতার, কুয়েত, ইরাক— শব্দগুলো এমনিতে জলভাত নদিয়ার সীমান্তঘেঁষা এই গ্রামগুলোয়। কাঠের আসবাবের ফ্রেম তৈরি বা ‘সেন্টারিং’য়ের কাজের ওখানে প্রচুর সুযোগ। খেয়ে না-খেয়ে লাখ টাকা দিয়ে ভিসা জোগাড়ের কসরতে ঠিকাদার-মারফত পৌঁছে গেলেই হল! পাল্টে যাবে ভবিষ্যৎ। কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় যেমন বেঙ্গালুরু-হায়দরাবাদে পড়াশোনা কি চাকরি করতে যাওয়া ছেলেমেয়ের খোঁজ মেলে, তেমনই এ তল্লাটে ঘর কে ঘর লোক ছুটছে পশ্চিম এশিয়ায়।

ঘরে-ঘরে বিদেশ থেকে আনা ডিভিডি প্লেয়ার, ক্যামেরা, লেপ-কম্বল, রিমোট-গাড়ি। ঘরের মানুষগুলোর বারো আনাই শিশু ও মহিলা। আশ্বিনে পাটক্ষেতের ফসল তুলে আঁশ ছাড়িয়ে মেঠো পথের ধারে যখন চূড়া করে রাখা হয় পাটকাঠি, তখনই যেন শোনা যায় ঘরে ফেরার আগমনি। আঙুলের কর গোনেন বধূ, মানুষটা আসতে আর ক’দিন!

একটা টিভি কি পাঁচ কেজি চাল নিয়ে ঢুকতে গেলেও মহাখোলা গ্রামে বিএসএফকে কৈফিয়ত দিতে হয়। তবু ঝলমল করে সংসার-সুখ! লটবহর নিয়ে ক্লান্ত অবয়ব গ্রামে ঢোকে পুজোর ছুটিতে। উত্তেজনায় পিচরাস্তায় উঠে পড়েন গৃহিনী।

ম্লান হাসেন দীপা। মনে পড়ে, ফেলে আসা পুজোর দিন। সংসার চলছে চেয়েচিন্তে। নমিতারও একই হাল। জলজ্যান্ত মানুষগুলো উবে যাওয়ার পরে কানাকড়িও মেলেনি। বিউটিশিয়ানের সরকারি কোর্সে পরীক্ষা দিচ্ছেন নমিতা। আর ঘরে বসে প্রাণপণে বিড়ি বাঁধছেন দীপা।

বুকে ঝিলিক মারা একটা ব্যথায় রোজ ইঞ্জেকশন নিতে হয়। বিড়ির গন্ধে দমে টান পড়ে। একটুতেই ক্লান্ত লাগে। ক’পা হেঁটে ঠাকুর দেখতেও ইচ্ছে করে না। হঠাত্ মাথার ছাদ সরে যাওয়া দু’সন্তানের মা হাসেন— এখন আমিই আমার গার্জেন।

২৯ বছরের যুবতীর সামনে ধূসর, মলিন পথ চাওয়া। টকটকে ভরা সিঁথির বেয়াড়া ঠাট্টা সম্বল।

abpnewsletters nadia housewife mosul iraq iraq nadia chapra islamic state mosul iraqbengali abducted bengali labour abducted riju basu onno pujo onnyo puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy