Advertisement
E-Paper

নারদের স্টিং অপারেশন, ঘুষ বিতর্কে জড়ালেন তৃণমূলের ১১ শীর্ষ নেতা

স্টিং অপারেশনের ভিডিও প্রকাশ করে তৃণমূলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনে ভিডিও প্রকাশ করল নারদ নিউজ নামে একটি ওয়েবসাইট। মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক মিলিয়ে তৃণমূলের অন্তত ১১ জন নেতা টাকা নিয়েছেন ঘুষ হিসেবে, দাবি নারদ নিউজের।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৬ ১৬:৩২

রাজ্যে নির্বাচনের প্রাক্কালে এক দিকে জোট যখন শাসক দল তথা তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন শাকের আঁটির মতো ঘাড়ে চাপল ‘স্টিং অপারেশন।’

আজ দিল্লির প্রেস ক্লাবে নারদ নিউজ নামে একটি ওয়েব পোর্টালের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে মুকুল রায়, সৌগত রায়, সুলতান আহমেদ, শুভেন্দু অধিকারী-সহ একাধিক তৃণমূল নেতা টাকার বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ওই পোর্টালের প্রতিনিধিরা একটি নকল সংস্থার নাম করে ওই টাকা ঘুষ হিসাবে তুলে দিচ্ছেন তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের হাতে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুষ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে পাঁচ লক্ষ টাকা।

আজ নারদা নিউজের পক্ষ থেকে ম্যাথু স্যামুয়েল বলেছেন, ‘‘গত ২০১৪ সাল থেকে এ বছরের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এই স্টিং অপারেশনটি চালানো হয়েছে। সারদা কাণ্ডের পরেই আমরা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হই। আমাদের কাছে সব মিলিয়ে ৫২ ঘণ্টার ফুটেজ রয়েছে। যার মধ্যে আজ ২৪ মিনিটের ভিডিও জনসমক্ষে আনা হয়েছে।’’ গোটা স্টিং অপারেশন মোট ৬৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্যামুয়েল। যে টাকা কেরলের এক ব্যবাসীয় দিয়েছেন বলে জানান তিনি। টাকার উৎস বা এ বিষয়ে যে কোনও তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত বলেও দাবি করেছেন স্যামুয়েলেরা।

দেখুন নারদ নিউজ-এর ইউটিউবে দেওয়া সেই ভিডিও:

ভোট শুরু হতে এক মাসও বাকি নেই। ঠিক তার আগে এই স্টিং অপারেশন সামনে আসায় হইচই শুরু হয়ে যায় দলের অন্দরমহলে। তৃণমূল নেত্রী বর্তমানে উত্তরবঙ্গে ভোট প্রচারে ব্যস্ত। তাই ফোন করে দ্রুত রণকৌশল ঠিক করেন তৃণমূল নেতৃত্ব। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়, দল এটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে না। স্রেফ বিবৃতি দিয়েই ছেড়ে দেবে। এই ভিডিওটি আসার পরেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, এটি ষড়যন্ত্র। ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানোর অপপ্রয়াস। ১৯ মে মানুষ এর জবাব দেবেন। দলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথায়, ‘‘নির্লজ্জ রাজনৈতিক বিরোধীদের এটাই বলতে চাই, সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আমাদের মোকাবিলা করুন। বাংলার মানুষ সব বোঝেন। জানেন। তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিতে আস্থা রাখেন।’’ আর মুকুল রায়ের কথায়: ‘‘নির্বাচনের আগে এটা দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। জাল ভিডিও। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যা শুনে চ্যালেঞ্জ করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘দেরি করছেন কেন? চ্যালেঞ্জ করুন না। মমতা বলছেন বাংলা হাসছে। আসলে বাংলা লুঠ হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকে স্বীকার করতে হবে তাঁর দলের লোকেরা চোর-ডাকাত-লুঠেরা।’’

কিন্তু যে ভাবে দলের শীর্ষনেতাদের নাম জড়িয়ে পড়েছে তাতে যথেষ্ট অস্বস্তিতে গোটা দল। সাংসদ ছাড়াও বর্তমান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বা ফিরহাদ হাকিমের নাম জড়িয়েছে এই কাণ্ডে। এ ছাড়া শুভেন্দু অধিকারী বা মুকুল ঘনিষ্ঠ সৈয়দ এম এইচ মির্জা— যাঁদের নাম এই কাণ্ডে উঠে এসেছে, তাঁরা প্রত্যেকেই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী। বিরোধীরা এই ভিডিওটি দেখিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার পরিকল্পনা নিলেও, তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার দাবি, ‘‘এ দেশে দুর্নীতির ঘটনা কেবল শহরের ভোটারদের প্রভাবিত করে। গ্রামীণ এলাকায় ততটা প্রভাব ফেলে না। সেই কারণে অরবিন্দ কেজরীবাল দিল্লিতে এত সফল।’’

আরও পড়ুন:

নারদ-কাণ্ডে একযোগে মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করলেন বিরোধীরা

মমতা এখনও নীরব, তৃণমূল বলল জাল ভিডিও! অভিযুক্তরা কী বলছেন?

তহেলকা স্টিং অপারেশনে সেই ১৪ মার্চ জর্জের ইস্তফা চেয়েছিলেন মমতা

যা নিয়ে এত বিতর্ক সেই ভিডিওটিতে ঠিক কী দেখা গিয়েছে?

ভিডিওতে প্রথম নিশানায় ছিলেন বর্ধমানের তৎকালীন পুলিশ সুপার তথা মুকুল ঘনিষ্ঠ সৈয়দ এম এইচ মির্জা। তাঁকে দেখা গিয়েছে পাঁচ লক্ষ টাকা নিতে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে মির্জা দাবি করছেন, তিনি তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের খুব কাছের লোক। এবং দলের হয়ে টাকা তোলেন। মুকুল রায়ের যে তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তা-ও বলতে শোনা যায় তাঁকে। মির্জার সূত্র ধরে প্রতিনিধিরা পৌঁছন মুকুল রায়ের কাছে। ঘুম ভাঙা চোখে মুকুল প্রতিনিধিদের জানান, মির্জাকে তাঁর সব বলা রয়েছে। ওঁর সঙ্গেই কথা বলুন। টাকা প্রসঙ্গে মুকুলের বক্তব্য, পিছনের ৬এ, এলগিন রোডে গিয়ে টাকা দিয়ে আসুন।

এর পর একে একে দেখা যায় পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, লোকসভার সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার, সুলতান আহমেদ, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ের মতো বর্ষীয়ান নেতাদের পাঁচ লক্ষ টাকা করে নিতে। দেখা গিয়েছে শুভেন্দু অধিকারীকেও। সুলতানকে বলতে শোনা যায়, তিনি ওই সংস্থার জন্য তাঁর ক্ষমতার মধ্যে যেটুকু করার তা করবেন। লবিও করবেন সংস্থার হয়ে। পাশাপাশি এ কথা বলতেও শোনা যায়, নির্বাচন আসছে। সামনে প্রচুর খরচ। ভিডিওতে কাকলিকে টাকা নিতে দেখা গেলেও আজ তিনি দাবি করেছেন, ভিডিওটি জাল। এমনকী যে ঘরে তিনি বসে রয়েছেন সেই ঘর বা টেবিল তিনি চিনতে পারছেন না। যা শুনে সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘ভিডিওটি জাল নয় তা স্পষ্ট। কেননা সুলতানের পিছনে যেমন মক্কার ছবি দেখা যাচ্ছে, তেমনই কাকলির পিছনে রয়েছে মা দুর্গার ছবি। ওটাই ওঁদের ঘরের বৈশিষ্ট্য।’’

ভিডিও দেখাচ্ছে, খুচরো পাঁচ লক্ষ টাকা হাতে নিতে চাননি নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। হাতকাটা গেঞ্জি পরে চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসা ববিকে বলতে শোনা যায়, তিনি যদি এত কম টাকার কাজ করেন, তা হলে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা কী করবে! ববির নির্দেশে একতলায় নেমে এসে এক প্রতিনিধি তাঁর এক কর্মীর হাতে ওই টাকা তুলে দেন। সারদা কাণ্ডে বর্তমানে জেলে বন্দি মদন মিত্র। কিন্তু বন্দিদশার আগের এই সময়কার এই ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, খাটে লুঙ্গি পরে অর্ধশায়িত মদন হাত বাড়িয়ে টাকা নিচ্ছেন প্রতিনিধিদের কাছ থেকে।

সরাসরি দেখা না গেলেও, তৃণমূল নেত্রীর অস্বস্তি বাড়িয়ে ভিডিওতে নাম উঠে এসেছে তাঁর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আজ সাংবাদিক সম্মেলনে স্যামুয়েলরা দাবি করেন, প্রতিনিধিদলটি অভিষেকের দফতরে গিয়ে তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে পাঁচ লক্ষ টাকা দেন। কর্ণ শর্মা ও সুজয় কৃষ্ণ নামে ওই দুই ব্যক্তি তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘‘এই বৈঠকের পরে আমি মন্ত্রীদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব। সেখান থেকে আপনারা ইতিবাচক সাড়া পাবেন।’’

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কলকাতার মেয়রকেও। শোভন তাঁদের রাজ্যের শীর্ষকর্তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে চার লক্ষ টাকা দিয়ে প্রতিনিধিরা বলেন, বাকি এক লক্ষ টাকা পরের দিন দেবেন। শোভনকে তখন বলতে শোনা যায়, বেশ কিছু বছর ধরে তিনি ডলার পাচ্ছেন। এর পর তাঁর চেয়ারের হাতলে রাখা তোয়ালে দিয়েই ওই টাকা মোড়াতে দেখা যায় শোভনকে। তাঁকে সব শেষে বলতে শোনা যায়, ‘‘যা হবে নির্বাচনের পরে।’’

আজকের এই ভিডিও প্রকাশের পরে এক দিকে যেমন নিন্দায় মুখর হয়েছে তৃণমূলবাহিনী, তেমনই বিষয়টিকে ভোটের অস্ত্র করে তুলতে তৎপর সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি— এই তিন বিরোধী দলই। রাজ্যে এক দিকে যেমন সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন সূর্যকান্ত মিশ্র, তেমনই দিল্লিতে সরব হয়েছেন সাংসদ মহম্মদ সেলিমও। তাঁর কথায়: ‘‘যাঁরা তৃণমূলে নিজেদের সৎ বলে মনে করেন তাঁরা দল থেকে সরে আসুন।’’ তৃণমূল নেত্রীকে আক্রমণ করে সেলিম বলেন, ‘‘যখনই মমতা ফেঁসে যান, তখনই উনি চুপ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও আগামী দু’দিন উনি তা করবেন।’’ কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগের দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘দল বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হবে।’’

যত বেলা গড়িয়েছে তত এক সুরে ভিডিওটি জাল বলে দাবি তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁদের বক্তব্য, সাংবাদিক ও যে ব্যবসায়ী টাকা বিনিয়োগ করেছেন তাঁরা সকলেই কেরলের। সিপিএম-কংগ্রেসের ওই জোট শক্তি পরিকল্পিত ভাবে এই ভিডিওর পিছনে রয়েছে বলেই অভিযোগ তৃণমূলের। এনডিএ জমানায় বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণের উপরেও স্টিং অপারেশন করেছিলেন এই ম্যাথু স্যামুয়েল। সে সময়ে স্যামুয়েলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিজেপি। কিন্তু আজ স্যামুয়েলের ভিডিওকে যে ভাবে বিজেপির সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ধ্রুব সত্য বলে দাবি করেছেন তা দেখে তৃণমূলের প্রশ্ন, ‘‘এখন বিরোধীদের বিরুদ্ধে ভিডিও করেছেন বলেই সব সত্যি হয়ে গেল। আর বিজেপির বিরুদ্ধে কিছু হলে তখন সেই সাংবাদিক বা ভিডিও জাল হয়ে যায়।

(নারদ নিউজের প্রকাশিত ভিডিওটির সত্যতা আমরা যাচাই করিনি)

TMC Top Leaders Bribe Controversy Narada News Sting Operation MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy