Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
বাড়ল নিরাপত্তাও

দিন বদলের জল্পনা উস্কে মুকুল-বার্তা

এগারো মাসের বরফ গলিয়ে বুধবার দিল্লিতে তাঁকে নৈশাহারে ডাকেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ঠিক তিন দিনের মাথায় মুকুল রায় বার্তা দিলেন, তিনি দলেই আছেন। এ দিন হুগলির ফুরফুরা শরিফে গিয়েছিলেন তিনি।

ফুরফুরে মেজাজে। শনিবার দুপুরে ফুরফুরা শরিফে পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির বাড়িতে মুকুল রায়। দীপঙ্কর দে-র তোলা ছবি।

ফুরফুরে মেজাজে। শনিবার দুপুরে ফুরফুরা শরিফে পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির বাড়িতে মুকুল রায়। দীপঙ্কর দে-র তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

এগারো মাসের বরফ গলিয়ে বুধবার দিল্লিতে তাঁকে নৈশাহারে ডাকেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ঠিক তিন দিনের মাথায় মুকুল রায় বার্তা দিলেন, তিনি দলেই আছেন। এ দিন হুগলির ফুরফুরা শরিফে গিয়েছিলেন তিনি। সেই ‘সফরকে’ আবার তৃণমূল নেত্রীর হয়ে দূতের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন দলীয় কোনও কোনও নেতা। অর্থাৎ, সেই অর্থে দলনেত্রীর কাজ করতে শুরু করে দিলেন তাঁর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এ দিনই আবার বাড়ানো হল মুকুলের নিরাপত্তার বহর।

যাবতীয় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে রাজনীতিকদেরই অনেকের প্রশ্ন, তা হলে কি মুকুলের ‘পুনর্বাসন প্রক্রিয়া’ পুরোদমে শুরু হয়ে গেল?

দিল্লি থেকে ফিরেই এ দিন ফুরফুরা শরিফে পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির সঙ্গে দেখা করতে যান মুকুল। আগামী শুক্রবার ফুরফুরায় যাওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। ঠিক তার আগে সেখানে গিয়ে ত্বহার সঙ্গে মুকুলের বৈঠকের পরে শুরু হয়েছে নতুন জল্পনা। গত এগারো মাসে ত্বহা-মুকুল একাধিক সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু তখন প্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ত্বহার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করে মুকুল নিজের রাজনৈতিক বিকল্পের পথ পরিষ্কারের চেষ্টা করছেন— এমন কথাও বলেছিলেন অনেকে। বুধবার দিল্লি-পর্বের পরে এখন পরিস্থিতি একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে। তৃণমূলের নেতাদেরই কেউ কেউ এ দিন বলেছেন, ‘‘মমতার দূত হয়েই ত্বহার কাছে গিয়েছিলেন মুকুল, ওই সভার আয়োজন নিয়ে বৈঠক করতে।’’ কেউ আবার আশা করছেন, ওই দিন মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মুকুলকে আবার আগের মতোই দেখা যেতে পারে।

মুকুলের নিজের কথাও সেই জল্পনায় বিস্তর ইন্ধন দিয়েছে। আগামী বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের প্রচারে তাঁকে দেখতে পাওয়া যাবে কি না, এই প্রশ্নের জবাবে মুকুল বলেন, ‘‘আগে ২০১৬ সাল আসুক। তখনই এই প্রশ্নের জবাব পাবে মানুষ।’’

তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠমহল সূত্রের খবর, মুকুলকে যে নতুন করে দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে, সে কথা বুধবারই তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। মুকুল-ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘পর দিন থেকে ওঁর শরীরী ভাষাই বদলে গিয়েছে!’’ শনিবার সম্ভবত মুকুল নিজেও সেই কথাটাই তৃণমূলে তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। এক দিকে তিনি যেমন ‘দলেই আছি’ বলে দাবি করেছেন, অন্য দিকে তাঁর যে অনুগামীরা নতুন দল গঠনের কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি বার্তা দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমি তাঁদের নেতা নই। সদস্যও নই। আমি তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন ধোঁয়াশা নেই। ধোঁয়াশাটা রয়েছে কিছু সাংবাদিকের মধ্যে।’’

মুকুল আরও বলেন, ‘‘এই পৃথিবীতে সব চাইতে বেশি পরিবর্তনশীল মানুষের মন। আজ যারা ঘৃণ্য, কাল তারাই পরমেশ্বর।’’ তাঁর এই কথাকেও তৃণমূলের বর্তমান একাধিক নেতার প্রতি বার্তা বলেই মনে করা হচ্ছে। দলের একাংশের ব্যাখ্যা, এত দিন ব্রাত্য হয়ে থাকা মুকুলের যে গুরুত্ব বাড়ছে, সেটাই তিনি এই কথার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন। দলের ওই নেতারা মুকুলেরই এ দিনের একটি কথাকে এর সমর্থনে তুলে ধরছেন। এ দিন মুকুলকে প্রশ্ন করা হয়, আবার সামনের সারিতে আসতে কত সময় লাগবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমারও হয়তো মনে হয়েছে, পিছনের সারি থেকে একটু সামনের সারিতে এলে ভাল হতো। মানুষের জীবনের এটাই গতি। এটাই তো নিয়ম।’’ অর্থাৎ, তিনি যে দলের সামনে সারিতে ফের আসতে চাইছেন, এই কথাতেই সেটা ধরা পড়েছে।

অন্য একটি পক্ষ অবশ্য বলছে, এখানে তিনি দলের নেত্রীর মন বদলের কথাই বলতে চেয়েছেন। সেই মন ফের বদলালে তাঁর পরিস্থিতি আগের মতোই হতে পারে। এ দিন মুকুল বলেন, ‘‘দল যখন যেমন দায়িত্ব দিয়েছে, পালন করেছি এবং করব। দল বহিষ্কার করলে করবে।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘তবে আমি এখনও দলেই আছি।’’ এই সূত্রে একটি তথ্যও দিচ্ছে ওই পক্ষ। বলছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে চিঠি দিয়েছেন মুকুল। সেই সাক্ষাতের পরেই নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। ওই দলের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘এর অর্থ, সব দরজাই খুলে রাখতে চাইছেন তিনি। কাল তাঁর মনে হতেই পারে, নতুন দল করলে ভাল! উনিই তো বলেছেন মানুষের মন পরিবর্তনশীল!’’

তবে এই তথ্যের অন্য একটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। তৃণমূল সূত্রে বলা হয়েছে, দিল্লিতে আরও সক্রিয় হতে বলা হয়েছে মুকুলকে। সেই সূত্রেই রাজ্যের ঝুলে থাকা রেল প্রকল্প নিয়ে দরবার করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছেন তিনি। গত কয়েক মাসে ফুরফুরায় যখন তিনি যেতেন, তার সঙ্গে এ দিনের ছবিও ছিল আলাদা। সব্যসাচী, শীলভদ্র বা শিউলি সাহা অনেক দিনই তাঁর সঙ্গে এই যাত্রায় নেই। কার্যত একাই তিনি এত দিন ফুরফুরায় গিয়েছেন। সঙ্গে ছিল শুধু পাইলট কার। এ দিন কিন্তু ছ’টি গাড়ির কনভয়ে মুকুল ফুরফুরায় যান। জাঙ্গিপাড়া থানার ওসি স্বপন ঠাকুরও হাজির ছিলেন সেখানে। তাঁর নিরাপত্তা এক ধাপ বাড়িয়ে এক্স থেকে ওয়াই ক্যাটেগরিতে তুলে আনার সিদ্ধান্তও এ দিনই ঘোষণা করেছে ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কমিটি। রাজ্যের নিরাপত্তা অধিকর্তা বীরেন্দ্র এ কথা জানিয়েছেন। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তে অবশ্য মুকুল কোনও নতুন কিছু দেখছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘মাওবাদীদের খতম তালিকায় আমার নাম রয়েছে। কেন্দ্র সেই কারণে রাজ্যকে সতর্ক করেছিল। রাজ্য দিল্লির পরামর্শ মেনে নিরাপত্তা বাড়ানোয় আমি খুশি।’’

নিরাপত্তার বাড়ার ফলে এখন থেকে মুকুল তিন জন সশস্ত্র দেহরক্ষী পাবেন। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে একটি এসকর্ট গাড়ি থাকবে। জেলায় গেলে পাইলট এবং এসকর্ট গাড়ি দু’টোই পাবেন তিনি। যদিও তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর মুকুলবাবু জেড ক্যাটেগরি-র নিরাপত্তা পেতেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতির জেরে নিরাপত্তাও কমেছিল। ফের তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানো নিয়ে স্বরাষ্ট্র দফতরের অবশ্য যুক্তি, মুকুলবাবুর নিরাপত্তা পর্যালোচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সেই পরামর্শই বাস্তবায়িত করা হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mamata bandopadhay mukul roy MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE