Advertisement
E-Paper

ঘরছাড়া নয়া প্রজন্ম, সাবেক রেস্তোরাঁয় বেলাশেষের গান

এই মধ্য ষাটেও মজাদার ডাম্পলিং বা পার্বণী রোস্ট তরিবত করে নিজেই রাঁধেন তিনি। ইদানীং কোমরের ব্যথাটা বড্ড ভোগাচ্ছে। ট্যাংরার ‘কিম ফা’ রেস্তোরাঁর কর্ণধার শে উই টং-কে দেখে অনেকেরই একটা চাপা আশঙ্কা দানা বাঁধে।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৬ ২৩:৫৯

এই মধ্য ষাটেও মজাদার ডাম্পলিং বা পার্বণী রোস্ট তরিবত করে নিজেই রাঁধেন তিনি। ইদানীং কোমরের ব্যথাটা বড্ড ভোগাচ্ছে। ট্যাংরার ‘কিম ফা’ রেস্তোরাঁর কর্ণধার শে উই টং-কে দেখে অনেকেরই একটা চাপা আশঙ্কা দানা বাঁধে। বন্ধু শে ইং শিং সেটাই বলছিলেন, ‘‘এ ভাবে আর কত দিন? ওঁর একমাত্র ছেলে কানাডায় থিতু। রেস্তোরাঁ চালানোর প্যাশন অটুট থাকলেও শরীর দিচ্ছে না।’’

বালিগঞ্জ ফাঁড়ির সদ্য বন্ধ হওয়া ‘ধাবা’র নেপথ্যেও একই কাহিনি। ৭১ বছরের বৃদ্ধ অবতার সিংহ স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘বুড়ো হয়েছি। ছেলেপুলেরা সব বিদেশে। এখন রিটায়ার করব!’’ ধাবা-র মখমলি ফিশ তন্দুরির সুঘ্রাণ তাই আপাতত স্মৃতির টিফিনবাক্সে।

কলকাতার বহু সাবেক রেস্তোরাঁর অন্দরেই ইদানীং বেলাশেষের আবহ।

ডালহৌসি পাড়ার ‘স্পেনসেস’, ‘পেলিতি’ থেকে ‘নানকিং’, ‘ফারপোজ’ না হয় সূদূর অতীত। কলকাতার এক কালের অহঙ্কার ‘স্কাইরুম’-এর যবনিকাপাতও হয়েছিল অনেকটা একই ধাঁচে। কর্ণধার প্রকাশনাথ মলহোত্র-র তিন কন্যাই বিদেশে থিতু হয়েছিলেন। অনেকের মত, এ মোটেই বিক্ষিপ্ত পারিবারিক কিস্‌সা নয়। রেস্তোরাঁ ব্যবসার ঝক্কি-ঝামেলার অনুপাতে লাভ ঢের কম। কলকাতায় অন্য ব্যবসার সুযোগও সীমিত। ফলে পরের প্রজন্ম পাততা়ড়ি গুটোচ্ছে। এ যেন সামগ্রিক ভাবে কলকাতা থেকে কমবয়সীদের মহানিষ্ক্রমণেরই এক খণ্ডচিত্র। পার্ক স্ট্রিটের ট্রিঙ্কাজ-এর কর্ণধার দীপক পুরীর সাফ কথা, ‘‘সুযোগ কমছে বলেই অনেকে শহর ছাড়ছেন।’’

১৯৪০-এর দশকে লাহৌর থেকে এসে শহরে থিতু হয়েছিল পুরী পরিবার। দীপকের বাবা ওমপ্রকাশ পুরী গ্র্যান্ড হোটেলের চাকরি ছাড়েন ১৯৫৯ সালে। ‘ট্রিঙ্কাজ’ তখন সাহেব মালিকের জিম্মায়। ইহুদি বন্ধু জোশুয়া এলিজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার ভার নিয়ে ভোল পাল্টে দেন ওম। ষাটোর্ধ্ব দীপকের পুত্র আনন্দ এখন দিল্লি-কলকাতা দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলছেন। ব্যবসার স্বার্থেই শহরের বাইরে দরজা খোলা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। দীপকের স্বীকারোক্তি, ‘‘৪০ বছর আগেও খানা-পিনা-গানার সন্ধে অন্য রকম ছিল। সত্তরের দশকেও ঢের বেশি ছিল কর্পোরেট অফিসের জাঁকজমক। ধারে-ভারে-উল্লাসে কলকাতার পাশে তখন দিল্লি-বম্বেও পানসে।’’

সে দিন আর নেই। শহরের সাবেক ফুড স্ট্রিট জুড়েই বহু পুরনো রেস্তোরাঁর গায়ে অনাদরের চিহ্ন। পাল্টেও গিয়েছে বহু ঠিকানা। ‘পিপিং’-এর কবেই ঝাঁপ বন্ধ। চিনে মালিক ওয়াং পরিবার কানাডা চলে যাওয়ার পরে হাত বদলেছে ‘ওয়ালডর্ফ’। সুরে-সুরায় বিনোদনের সাহসী মাঠ ‘ব্লু-ফক্স’ও নিশ্চিহ্ন।

পার্সি সমাজের প্রয়াত ডালি রতনজি বাসানিয়া লাউডন স্ট্রিটের ‘হোটেল রাতদিন’ আর ‘অলিপাব’— দুটোই টানছিলেন। এখন ‘রাতদিন’ ভেঙে বহুতল উঠছে। রতনজির তিন মেয়ের দু’জনই অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। ‘অলিপাব’-এর সঙ্গে আছেন ছোট মেয়ে আনজিম।

পরের প্রজন্ম কী করবে জানে না ‘কোয়ালিটি’র ঘাই পরিবারও। ১৯৫০-এর দশকে পাক পঞ্জাবের ঝিলম থেকে এখানে ঘাঁটি গেড়েছিলেন তাঁরা। রাজীব ঘাইয়ের মেয়ে তনভি কনফেকশনারির কাজ শিখে কলকাতায় ফিরলেও একটা অনিশ্চয়তা রয়েই গিয়েছে।

‘অম্বর’-খ্যাত খুল্লার পরিবারও স্রেফ কলকাতার ভরসায় পড়ে নেই। রাওয়ালপিন্ডির সরকারি আমলা জ্ঞানচন্দ খুল্লার দেশভাগের সময়ে শহরে আসেন। তাঁর দুই পুত্র রাজপাল ও সুদেশের হাতে ‘অম্বর’-এর পত্তন। রাজপালের ছেলে দীপক পরে গড়ে তোলেন ‘জারাঞ্জ’। সুদেশের পুত্র সঞ্জয় ‘অম্বর’ সামলাচ্ছেন। দীপক ও সঞ্জয়ের সন্তানেরা ইউরোপে হোটেল ম্যানেজমেন্টের পাঠ নিয়ে শহরে ফিরেছেন। দীপকের পুত্র রাঘবের দু’টি নয়া রেস্তোরাঁ খোলার পরিকল্পনাও আছে। কিন্তু তিনিও বলছেন, ‘‘পুণে, বেঙ্গালুরুতে রেস্তোরাঁ-ব্যবসার সম্ভাবনা এখন ঢের বেশি!’’

ব্যতিক্রম বলতে ‘মোক্যাম্বো’, ‘পিটারক্যাট’, ‘বার-বি-কিউ’। ‘ফ্লুরিজ’ ছাড়া এই তিনটিই আজও পার্ক স্ট্রিটের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। করাচির ‘সিন্দ অবজার্ভার’ পত্রিকার কর্ণধার শৈলেন্দ্র শিবজী বেলজী কোঠারি ১৯৪৭ নাগাদ কলকাতায় আসেন। ‘মোক্যাম্বো’-র পত্তন তাঁরই হাতে। বড় ছেলে শৈলেন্দ্র পরে ‘বার-বি-কিউ’ আর ছোট ছেলে নীতিন ‘পিটার ক্যাট’-এর রূপকার। নীতিনের ছেলে সিদ্ধার্থও ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। শৈলেন্দ্র-পুত্র রাজীব সামলাচ্ছেন ‘বার-বি-কিউ’ আর ‘ওয়ান স্টেপআপ’। তবে সত্তর-ছুঁইছুঁই নীতিনও মানছেন, লড়াই দিন-দিন কঠিন হচ্ছে।

কলকাতার ভোজ-বিলাস কি তবে একেবারেই পড়তির দিকে? তা হলে সল্টলেক, সেক্টর ফাইভ, দক্ষিণ কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় নতুন নতুন রেস্তোরাঁই বা জন্মাচ্ছে কী করে? ‘মেনল্যান্ড চায়না’, ‘ওহ্‌ ক্যালকাটা’, ‘কাফে মেজুনা’ প্রমুখ ব্র্যান্ডের কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় কিন্তু আশাবাদী। ‘‘উত্তমকুমারই কি চিরকাল হিরো থাকবেন?’’ তবে অঞ্জনকেও মানতে হচ্ছে, ‘‘কলকাতায় রেস্তোরাঁ যত হচ্ছে, খাইয়ের সংখ্যা তত বাড়ছে না। আজকের রেস্তোরাঁর মূল চালিকাশক্তি, রেস্তদার তরুণ-তরুণীর সংখ্যা মুম্বই-বেঙ্গালুরুতে ঢের বেশি।’’

নতুন রেস্তোরাঁর দশাও কিন্তু সার্বিক ভাবে ভাল নয় বলেই দাবি করছেন দীপক খুল্লার। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু বহুজাতিক ব্র্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজি আর বিরিয়ানি, চাইনিজের চেন ছাড়া সফল নতুন রেস্তোরাঁর সংখ্যা হাতে-গোনা।’’ তাঁদেরই এক জন, ছক-ভাঙা বাঙালি রান্নার ঠেক ‘বোহেমিয়ান’-এর রূপকার জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘এখানে ব্যবসার বাড় অনেক ঢিমে, এটা মানতেই হবে।’’

অর্থনীতির হাঁড়ির হালেই কি তা হলে মার খাচ্ছে শহরের খানাপিনা-সংস্কৃতি? নাকি স্রেফ কালের নিয়মেই মুছে যাচ্ছেন পুরনোরা? এই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ‘চাওম্যান’ এবং ‘অউধ ১৫৯০’-এর কর্ণধার শিলাদিত্য ও দেবাদিত্য চৌধুরী ভরসা রাখছেন কলকাতাতেই। দেবাদিত্যর কথায়, ‘‘সাবেক রেস্তোরাঁ অনেকেই প্রচারের দিকটা তত জোর দেয় না। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সেটাও এখন জরুরি।’’

restaurants kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy