Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
এ বার লালগোলা

পোড়া কাগজ পড়ে, উধাও প্রতিষ্ঠাতা

নোটিসটা ঈদের ছুটির। ছুটি ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত। তার পর দিন হাজির না হলে ৫০ টাকা জরিমানা। তার পরেও গরহাজির থাকলে প্রতিদিন জরিমানা ১০ টাকা করে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের লালগোলার মকিমনগরের এক অননুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই নোটিস যিনি দিয়েছেন, সেই মোফাজ্জুল শেখ কবে আবার সেখানে হাজির হবেন বা আদৌ হাজির হবেন কি না তা নিয়েই ধন্দ দেখা দিয়েছে।

অনল আবেদিন ও বিমান হাজরা
লালগোলা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১১
Share: Save:

নোটিসটা ঈদের ছুটির। ছুটি ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত। তার পর দিন হাজির না হলে ৫০ টাকা জরিমানা। তার পরেও গরহাজির থাকলে প্রতিদিন জরিমানা ১০ টাকা করে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের লালগোলার মকিমনগরের এক অননুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই নোটিস যিনি দিয়েছেন, সেই মোফাজ্জুল শেখ কবে আবার সেখানে হাজির হবেন বা আদৌ হাজির হবেন কি না তা নিয়েই ধন্দ দেখা দিয়েছে। কারণ, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে অভিযুক্ত আব্দুল হাকিম, রাজিয়াবিবি, আলিমাবিবির সূত্রে মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসা ছাড়াও জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) রেডারে রয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিস্ফোরণ-কাণ্ডের পরে সপরিবার এলাকাছাড়া ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মোফাজ্জুল।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০৮ সালে মকিমনগরে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন স্থানীয় বাসিন্দা পাট-আলু-ডিমের ব্যবসায়ী তথা রাজমিস্ত্রির ঠিকাদার মোফাজ্জুল। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ হয় ২ অক্টোবর। ৭ অক্টোবর থেকে তিনি সপরিবার নিখোঁজ। তবে বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধৃত রাজিয়া, আলিমা ও হাকিমের ছবি সংবাদমাধ্যমে দেখে চমকে উঠেছিলেন এলাকাবাসী। সাত-আট মাস আগেও হাকিমকে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রান্না করতে দেখেছেন তাঁরা। সেই সুবাদেই সেখানে যাতায়াত ছিল রাজিয়া-আলিমার।

মঙ্গলবার ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেল, ভবনটির দু’টি অংশ। একটিতে ঢালাই ছাদ রয়েছে। আর একটি ইটের গাঁথনি দেওয়া, ছাদ টিনের। অফিসঘর তালাবন্ধ। বাইরের দিকে শুধু একটি জানলা খোলা। দু’টি স্নানাগার ও সাতটি শৌচাগার রয়েছে। শৌচাগারের একটিতে পড়ে রয়েছে কিছু পোড়া কাগজ। এতটাই পুড়েছে যে, তা থেকে কিছু উদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব। ১৪টি ঘরের একটিতে পড়ে আছে বেশ কয়েকটি ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। আর একটিতে দেখা গিয়েছে একটি সিম-কার্ড। ভাঙা। রান্নাঘরের পাশের ঘরে একটি সাইকেল ও দু’টি মোটরবাইক, একটি মোটরবাইকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর অন্য জেলার। প্রতিটি ঘরেই রাখা রয়েছে ট্রাঙ্ক। এবং সেগুলোর বেশিরভাগই তালাবন্ধ। কিছু খোলা ট্রাঙ্কে রয়েছে বই ও জামাকাপড়। রান্নাঘরে দু’টি বড় কাঠের উনুন, একটি গ্যাস সিলিন্ডার। আর আছে চাল, নুন ও লঙ্কাগুঁড়ো।

এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৌচাগারে যে পোড়া কাগজ মিলেছে, তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আমাদের অনুমান, আপত্তিকর কোনও নথি পোড়ানো হয়েছে।” মোফাজ্জুলের খোঁজ চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এলাকাটি বাংলাদেশের গোদাগাড়ি উপজেলা থেকে বড়জোর ৯ কিলোমিটার দূরে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই। স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রথম দিকে নদিয়ার দেবগ্রামে নিজের শ্বশুরবাড়িতে থেকে লোহার ব্যবসা করতেন মোফাজ্জুল। বছর দশেক আগে গ্রামে ফিরে তিনি ঠিকাদারির পাশাপাশি ডিম, আলু ও পাটের কারবার শুরু করেন। ২০০৮ সালে মকিমনগরে নিজের বাড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। ২০১১ নাগাদ তিনশো মিটার দূরে মাঠের মধ্যে ১২ কাঠা জমি কিনে বাড়ি তৈরি করে সেখানে পড়ানোর বন্দোবস্ত করেন তিনি। শুরু থেকেই এখানে শুধু ছাত্রীরা পড়ত। প্রথম দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে দু’-এক জন পুরুষ শিক্ষক থাকলেও পরবর্তী কালে শিক্ষিকারাই পড়াতেন। ১৩০ জন ছাত্রী বর্তমানে সেখানে পড়াশোনা করে। অর্ধেকের বেশি পড়ুয়া আবাসিক। জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা ছাত্রীরাও রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি মাসে দেড়শো টাকা। আবাসিকদের প্রতি মাসে আরও ৪০০ টাকা করে বেশি দিতে হয়। প্রতিটি ক্লাসঘরে পাখা, আলো ও ঘড়ির ব্যবস্থা থাকলেও বসার কোনও বেঞ্চ বা চেয়ার নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ছাদে চার দিকে প্রাচীর অন্তত পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, ছাদে কী হচ্ছে।

এনআইএ সূত্রের দাবি, হাকিম-রাজিয়াদের জেরা করে তারা জেনেছে, শিমুলিয়ার মতো পড়ুয়াদের জেহাদি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করা বা জঙ্গি-প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো এখানে। এমনকী, ভিন্ দেশ থেকে আসা লোকও ‘মগজ ধোলাই’-এর কাজে আসত বলে সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা।

বিস্ফোরণের তদন্তে নাম উঠে আসায় গত ৯ অক্টোবর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যান পুলিশ ও গোয়েন্দারা। কিন্তু মোফাজ্জুলকে পাননি। স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশকে জানিয়েছেন, পরিবারটি কোথায় তাঁরা জানেন না। পুলিশ সূত্রের দাবি, মোফাজ্জুলের গোটা তিনেক মোবাইল নম্বর রয়েছে। তার একটিতে ফোন করে তাঁকে ওই প্রতিষ্ঠানে ডাকে পুলিশ। তিনি সেখানে আসার প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু আসেননি। তার পর থেকে তাঁর ওই নম্বরের মোবাইলটি বন্ধ। অন্য যে দু’টি নম্বর রয়েছে, সেগুলিতে ডায়াল করলে কেউ ফোন ধরছে না।

মোফাজ্জুলের সঙ্গে তাঁদের বিশেষ বনিবনা হত না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে। এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেছেন, “এই প্রতিষ্ঠানে মাঝেমধ্যে কিছু পুরুষ আসতেন, তাঁদের বিবিরা সেখানে লেখাপড়া করেন, এই পরিচয় দিয়ে।” তাঁদের একটা বড় অংশের সংযোজন, “টিভিতে হাকিম, আলিমা ও রাজিয়াকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। ওদের সবাইকেই তো চিনি। ভেবেছিলাম, মোফাজ্জুলের কাছে কী হয়েছে জানতে চাইব। কিন্তু ও তো সপরিবার নিখোঁজ!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE