Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
অচল বাকি ৬

‘খবর নেই’ জঙ্গলমহলকে দেওয়া ১৬ অ্যাম্বুল্যান্সের

প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর হুকুম তামিল করতে তত্‌পর হয়েছিল কলকাতা পুরসভা। সেই মতো জঙ্গলমহলের পিছিয়ে পড়া তিন জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ২২টি ট্রমাকেয়ার অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পর থেকে ওই তিন জেলার সরকারি হাসপাতালে ৬টি অ্যাম্বুল্যান্স স্রেফ পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৯
Share: Save:

প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর হুকুম তামিল করতে তত্‌পর হয়েছিল কলকাতা পুরসভা। সেই মতো জঙ্গলমহলের পিছিয়ে পড়া তিন জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ২২টি ট্রমাকেয়ার অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পর থেকে ওই তিন জেলার সরকারি হাসপাতালে ৬টি অ্যাম্বুল্যান্স স্রেফ পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ। আর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাতে তুলে দেওয়া বাকি ১৬টির কোনও খবর নেই।

জরুরি পরিষেবার যাবতীয় উপকরণ নিয়ে তৈরি ট্রমাকেয়ার অ্যাম্বুল্যান্সগুলির এমন পরিণতি হল কেন, তার খবর স্বাস্থ্য ভবন থেকে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তা কারও কাছে নেই! তবে জেলা প্রশাসনের এক কর্তার আক্ষেপ, “জেলা সফরে এলে মুখ্যমন্ত্রী অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তার কতটা পূরণ হল, অথবা পূরণ হলেও কতটা কাজে লাগল তার হিসেব কেউ রাখে না।”

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, নতুন সরকারের আমলে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে দফায় দফায় ওই তিন জেলায় অ্যাম্বুল্যান্স পাঠিয়েছে কলকাতা পুরসভা। এর মধ্যে প্রথম দফায় পশ্চিম মেদিনীপুরে স্বাস্থ্য বিভাগকে পাঁচটি এবং পুরুলিয়ার বাঁশগড় গ্রামীণ হাসপাতালে একটি পাঠানো হয়। এই দুই জেলার স্বাস্থ্যকর্তারাই স্বীকার করেছেন, অ্যাম্বুল্যান্স চালানোর জন্য প্রাক্তন সেনাকর্মীদের থেকে চালক নিয়োগ করা হয়েছে। এ জন্য তাঁরা ১৫ হাজার টাকা করে বেতন পান। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সগুলি প্রায় অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। চালকদের কোনও কাজ নেই।

কেন এই হাল? পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা গিরিশচন্দ্র বেরার জবাব, ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল ও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে রাখা দু’টি অ্যাম্বুল্যান্স তবু কিছু ব্যবহার হয়। কিন্তু মোহনপুর ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বেলপাহাড়ি গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও নয়াগ্রাম ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তিনটি অ্যাম্বুল্যান্স পড়েই থাকে। তাঁর ব্যাখ্যা, “গাড়িগুলি নিয়মিত ব্যবহার করতে হলে যে সংখ্যক ডাক্তার, নার্স বা প্যারামেডিক্যাল স্টাফের প্রয়োজন, তা নেই।”

আবার, অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহার নিয়ে পুরুলিয়ার প্রাক্তন মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা নিশিকান্ত হালদার শুনিয়েছেন অন্য কথা। “কী ভাবে গাড়িটি ব্যবহার করা হবে, রোগীদের পরিষেবা দেওয়া হবে, স্বাস্থ্য দফতরের কাছে বার-বার সেই গাইডলাইন চেয়ে পাঠিয়েছি। কোনও জবাব আসেনি” বলেন তিনি। তা হলে অ্যাম্বুল্যান্সটি কী হয়? নিশিকান্তবাবুর জবাব, “জেলায় মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরা এলে তাঁদের কনভয়ের পিছনে ওই অ্যাম্বুল্যান্স জুড়ে দেওয়া হয়। অন্য সময় পড়ে থাকে।”

সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পড়ে থাকা অ্যাম্বুল্যান্সগুলি তবু চোখে দেখা যায়। কিন্তু সরকারি বদান্যতায় তিন জেলার যে সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ১৬টি অ্যাম্বুল্যান্স পেয়েছিল, তারা নিখোঁজ! এর মধ্যে পাঁচটি বাঁকুড়ায়, সাতটি পশ্চিম মেদিনীপুরে এবং চারটি পুরুলিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, বাঁকুড়ায় যে অ্যাম্বুল্যান্সগুলি পাঠানো হয়েছিল সেগুলির রেজিস্ট্রেশন, রোড ট্যাক্স ও বিমাবাবদ ৫৭ হাজার টাকা খরচ করেছিল জেলা স্বাস্থ্য দফতর। পরে তা তিনটি এনজিও-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসন সূত্রে খবর, ওই তিন এনজিও-এর কোনও অস্তিত্বই এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এনজিও-কে দেওয়া বাকি দু’টি অ্যাম্বুল্যান্সেরও কোনও হদিস নেই।

অ্যাম্বুল্যান্স-কাণ্ড নিয়ে কী বলছেন স্বাস্থ্য কর্তারা?

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “ওই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। স্বাস্থ্য দফতরের যুগ্ম স্বাস্থ্য অধিকর্তা (পরিবহণ) বলতে পারবেন।” যুগ্ম স্বাস্থ্য অধিকর্তা (পরিবহণ) পার্থসারথি পালের উত্তর, “বাঁকুড়ার স্বাস্থ্যকর্তারা এ ব্যাপারে আমাকে কোনও তথ্য দেননি। ফলে আমাদের খাতায় আম্বুল্যান্সগুলি নথিভুক্তই নেই।” বাঁকুড়ার তত্‌কালীন মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা জগন্নাথ দিন্দা মারা গিয়েছেন। বর্তমান মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর বক্তব্য, “জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের নথিপত্রে ওই এনজিওগুলির নাম ও ঠিকানা রয়েছে। কিন্তু সেখানে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। গাড়িগুলি কোথায় আছে, কী ভাবে ব্যবহার হচ্ছে— তা জানা যাচ্ছে না।” পশ্চিম মেদিনীপুরের স্বাস্থ্য কর্তারা জানান, তাঁদের জেলায় অ্যাম্বুল্যান্স-প্রাপক এনজিও কর্তাদের এখন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্রোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “অনেক দিন আগের ব্যাপার। কবে, কাকে কী দিয়েছি মনে রাখা সম্ভব নয়। আর একবার দিয়ে দেওয়ার পর সেগুলি কী ভাবে ব্যবহার হচ্ছে সে সব আমাদের খোঁজ নেওয়ার কথাও নয়।”

বুধবার জঙ্গলমহলের উদ্দেশে ফের ঝাড়গ্রাম গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্সগুলির খবর পেতে স্বাস্থ্য কর্তা, অথবা পুলিশকে কোনও নির্দেশ দেবেন কি না— তা কেউ জানেন না। তবে কলকাতার পাঠানো মুখ্যমন্ত্রীর দামী উপহার নিয়ে ওই জেলাগুলির চালু রসিকতা হল, জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের আনাগোনা শুরু হলেও নিখোঁজ অ্যাম্বুল্যান্সের কোনও খবর নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE