Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কোথায় তারা? সুন্দরবন চষে ফেলেও খোঁজ নেই

তাদের জ্ঞাতি-গুষ্টিরা সকলে আছে। ঘুরতে-ফিরতে ভুস করে ভেসে উঠেছে। টুপ করে ফের ডুব দিয়েছে। কিন্তু যাদের খোঁজে এত আয়োজন, সুন্দরবনের জল তোলপাড় করেও সেই গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুকদের দেখা মেলেনি!

রাজীবাক্ষ রক্ষিত ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
গুয়াহাটি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০৩:২৭
Share: Save:

তাদের জ্ঞাতি-গুষ্টিরা সকলে আছে। ঘুরতে-ফিরতে ভুস করে ভেসে উঠেছে। টুপ করে ফের ডুব দিয়েছে। কিন্তু যাদের খোঁজে এত আয়োজন, সুন্দরবনের জল তোলপাড় করেও সেই গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুকদের দেখা মেলেনি!

সুন্দরবনের ডলফিনেরা কেমন আছে যাচাই করতে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ৭৭৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। গাঙ্গেয় ডলফিনের আকাল সংক্রান্ত তথ্যটি তা থেকেই বেরিয়ে এসেছে। সুন্দরবনের খাঁড়িতে সমীক্ষকদের চোখে ধরা পড়েছে শুধু ইরাবতী ও ইন্দো-প্যাসিফিক হাম্পব্যাক প্রজাতির ডলফিন।

২০০২-এ বাংলাদেশের সুন্দরবনে ডলফিন-সমীক্ষা হয়েছিল। ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া ও অসমের পশুপ্রেমী সংগঠন ‘আরণ্যক’ ২০১৪-য় পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সুন্দরবনে সমীক্ষা চালায়। গবেষকদলে ছিলেন ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’-এর ডলফিন-বিশেষজ্ঞ আব্দুল ওয়াকিদও। তাদের রিপোর্ট সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঘরে জমা পড়েছে। যদিও সরকারের তরফে তা প্রকাশ্যে আনা হয়নি।

সুন্দরবনে শুশুক একেবারে নেই— এ তথ্যে এখনই সিলমোহর বসাতে অবশ্য এ রাজ্যের বিশেষজ্ঞরা নারাজ। কিন্তু তাঁরা মেনে নিচ্ছেন যে, ওই তল্লাটে শুশুকের সংখ্যা যথেষ্ট কমে গিয়েছে। ‘‘সুন্দরবনে শুশুক কমেছে ঠিকই। তবে একেবারে হারিয়ে যায়নি।’’— বলছেন প্রবীণ সমুদ্র-বিজ্ঞানী অমলেশ চৌধুরী। তাঁর দাবি, ‘‘সাগর বা নামখানার কাছে আমি নিজেই শুশুক দেখেছি।’’ রাজ্য বন দফতরের একাংশের পর্যবেক্ষণ: ফরাক্কা থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত গঙ্গায় শুশুক যে ভাবে কমেছে, তাতে সুন্দরবনে শুশুকের আকাল অস্বাভাবিক নয়।

ভারতে জাতীয় জলজ প্রাণীর তকমা পেয়েছে শুশুক। আবার বিপন্ন প্রজাতির তালিকাতেও সে প্রথম সারিতে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ঠিকঠাক সংরক্ষণ করা না-হলে প্রাণীটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

এমতাবস্থায় সুন্দরবনের শুশুক-সমীক্ষার ফলাফল আরণ্যকের গবেষকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, পূর্ব সুন্দরবনের ১১টি খাঁড়িতে ২৮৯ কিলোমিটার ও পশ্চিমে ২৩টি খাঁড়ির ৪৮৭ কিলোমিটার পথে তাঁরা সমীক্ষা চালিয়েছিলেন, বিশেষ কায়দায় তৈরি লঞ্চে সওয়ার হয়ে। চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ডলফিন খুঁজতে বিদেশি হাইড্রোফোন ব্যবহার করা হয়েছিল। ডলফিনদের বসতি বাছাইয়ের প্রকৃতি ও বিন্যাসের ধারা সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ হয়েছিল। ওঁদের দাবি, পূর্ব সুন্দরবনে ইরাবতী ডলফিন বেশি দেখা গিয়েছে। আর ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিনের অস্তিত্ব টের পাওয়া গিয়েছে শুধু পশ্চিম সুন্দরবনে। রিপোর্ট অনুযায়ী, মোট ১৪৩টি ইরাবতী ও ২৮টি হাম্পব্যাকের দেখা মিলেছে সুন্দরবনে।

প্রাণী-বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, লাগামছাড়া দূষণ, ট্রলারের দাপাদাপি ও মাছ-ধরা জালের দৌলতে গোটা দেশেই শুশুকেরা সঙ্কটে। পরিবেশ সংগঠন ডব্লিউডব্লিউএফ বছরখানেক আগে ফরাক্কা থেকে সাগর পর্যন্ত গঙ্গায় সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতেও এই ছবিটা ধরা পড়ে। কী রকম?

সে বারও গবেষকেরা দেখেছিলেন, শুশুকের সংখ্যা কমছে। যে সব জায়গায় আগে শুশুক দেখা যেত, সেখানে তারা এখন কার্যত নিরুদ্দেশ। বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, গঙ্গায় দূষণবৃদ্ধির কারণে শুশুকের খাবার, অর্থাৎ মাছ ও ক্ষুদ্র জলজ প্রাণীর সংখ্যায় টান পড়েছে। শুশুকদের জীবনযাত্রাতেও দূষণের প্রভাব স্পষ্ট। মাছ-ধরা জাল বা ট্রলারের পাখায় জখম হয়ে শুশুকমৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়। সম্প্রতি শুশুক সংরক্ষণ নিয়ে কলকাতায় একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল ডব্লিউডব্লিউএফ। এমন উদ্বেগজনক নানা তথ্য সেখানে শোনা গিয়েছে।

এবং এ হেন প্রক্ষাপটে বিশেষজ্ঞেরা জোর দিচ্ছেন বিস্তারিত সমীক্ষার উপরে। আরণ্যকের গবেষকদের আক্ষেপ, সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ‘কোর’ এলাকা, হ্যালিডে দ্বীপ ও লোথিয়ান দ্বীপ অভয়ারণ্যে তাঁরা সমীক্ষা চালানোর অনুমতি পাননি। শুধু তা-ই নয় সাম্প্রতিকতম সমীক্ষাটির রিপোর্টও রাজ্য সরকার এখনও জনসমক্ষে না-আনায় অনেকে হতাশ। রিপোর্ট কেন আড়ালে?

বন দফতরের এক কর্তার যুক্তি, সুন্দরবনের শুশুক সংক্রান্ত আরণ্যকের একটি রিপোর্ট জমা পড়লেও তা অসমাপ্ত। তাই সেটি প্রকাশ করা হয়নি। ওদের ফের সমীক্ষা চালাতেও বলা হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dolphin sunderban
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE