মায়ের কাছে: বালিগঞ্জের বাড়িতে নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিজিৎ। মঙ্গলবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
দিল্লির মাটি ছাড়ার সময়ে ঘোষণাটা হল বিমানের মধ্যে। কলকাতায় নামার সময়েও সেই একই ঘোষণা— ‘‘আমরা গর্বিত যে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে আমাদের সংস্থার উড়ানেই প্রথম বার নিজের বাড়িতে ফিরছেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ এক প্রস্ত সংবর্ধনা হয়ে গেল সেই বিমানের মধ্যেই। অভিজিৎবাবুর হাতে ফুল ও হাতে-লেখা চিঠি তুলে দিল বিমান সংস্থা। বিমানকর্মীদের সঙ্গে ছবি তোলার অনুরোধ জানালেন পাইলট স্বয়ং। মেটাতে হল সই-শিকারীদের আবদারও।
মঙ্গলবার সন্ধে ৭টায় এ ভাবেই নিজের শহর ছুঁলেন নোবেলজয়ী। ফিরলেন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ফ্ল্যাটে, তাঁর মায়ের কাছে। আপাতত কী পরিকল্পনা? অভিজিতের ছোট্ট জবাব, ‘‘একটাই প্ল্যান— কথা না-বলা।’’ কারণ, তাঁর গলার অবস্থা খারাপ।
প্রতি বার কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেই বন্ধুদের ফোন করে জানিয়ে দেন, তিনি এসেছেন। এ বার অবশ্য ফোন করতে পারেননি। তবে তাঁকে ঘিরে বিমানবন্দরের ভিতরে-বাইরে উচ্ছ্বাস দেখে বলে ফেললেন যে, মাস তিনেক আগেও কলকাতায় এসেছিলেন। তখন কেউই অপেক্ষায় ছিল না। এ বার বদলে গিয়েছে ছবিটা।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিমানে লিভার ফাউন্ডেশনের সচিব অভিজিৎ চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র।
বিমান থেকে নেমে বিশেষ গল্ফ কার্টে অভিজিৎ এলেন বিমানবন্দরের গেট পর্যন্ত। সমস্ত ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ডে ফুটে উঠল স্বাগতবার্তা। বাইরে তখন অপেক্ষমাণ জনতা। মুখ্যমন্ত্রী শহরে না-থাকায় নোবেলজয়ীকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে এসেছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী ব্রাত্য বসু, বিমানবন্দরের অধিকর্তা কৌশিক ভট্টাচার্য। ফুলের তোড়া দিলেন তাঁরা। বিমানবন্দরে একাধিক ছবি ও নিজস্বীর অনুরোধও রাখতে হল ক্লান্ত অভিজিৎকে। তার ফাঁকেই বললেন, ভিড় সামলানোর অভ্যাস নেই একেবারেই। এত মানুষকে কী ভাবে সামলাবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। এর পর মেয়রের গাড়িতেই রওনা হলেন বাড়ির পথে।
খেতে ভালবাসেন সবই। নিজে রাঁধতেও ভালবাসেন। মঙ্গলবার দুপুর থেকে তাই অভিজিতের জন্য নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাতলা মাছের পেটির কালিয়া, মাংসের কাবাব, মুড়িঘণ্ট আর পায়েস রান্না করিয়েছেন তাঁর মা নির্মলাদেবী। ‘বড়দা’র জন্য সযত্নে রাতের খাবারের সে সব পদ রেঁধেছেন নির্মলাদেবীর ২৪ ঘণ্টার সঙ্গী রমা হালদার। পায়েসের সঙ্গে শুভ ক্ষণের যোগ, তাই পায়েস তৈরির সময়ে কয়েক বার হাত লাগিয়েছিলেন নির্মলাদেবী। এর আগে অভিজিতের পছন্দের সাবুর বড়া বানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খাইয়েছিলেন রমা। ভেবেছিলেন অভিজিৎ ফিরলে মোচার চপ বানিয়ে খাওয়াবেন। কিন্তু এ দিন বাড়িতে মোচা না-থাকায় সেই পরিকল্পনা স্থগিত রইল।
সুখবরটা আসার পর থেকেই বাড়িতে বিভিন্ন স্তরের লোকের আনাগোনা বেড়েছে। নির্মলাদেবী জানালেন, অভিজিতের বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে ছেলের সাফল্য উদ্যাপন করতেন নিশ্চয়ই। তবে তিনি ব্যাপারটা পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন
বলেই নোবেলজয়ীর মা যোগ করলেন, ‘‘আমি অবশ্য ওটা পারি না!’’ তাঁর পুত্রও বেশি ভিড়-হুল্লোড় পছন্দ করেন না। তবে নির্মলাদেবীর মতে, তাঁর ধৈর্য খুব। তাই হয়তো সামলে নেবেন। ঠাকুমা শতদল বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব আদরের ছিলেন অভিজিৎ। ঠাকুর্দা যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল, তার পরে উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ভাই অনিরুদ্ধেরও খুব প্রিয় দাদা অভিজিৎ। দিল্লি থেকে ফোনে অনিরুদ্ধ বললেন, ‘‘তিন দিন দেখা হয়েছে আমাদের।’’
মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই নির্মলাদেবীর সঙ্গে দেখা করে অভিজিতের জন্য উপহার দিয়ে গিয়েছেন। তবে বাইরে বেরোনোর সময় হয়নি বলে নির্মলাদেবী আর ছেলের জন্য কোনও উপহার কিনতে পারেননি। কী কথা হবে ছেলের সঙ্গে? উত্তরে বললেন, ‘‘অর্থনীতি, গবেষণা বা পরের কোনও বই নিয়ে আলোচনার সময়ই হবে না।’’ তা হলে কি পুরনো স্মৃতি নিয়ে গল্প? বাইরে কোথাও যাবেন? ‘‘কোথাও যাওয়ার সময় নেই। ওর বন্ধুরা আসবেন, তাঁদের সঙ্গেই কথা হবে,’’ বললেন নির্মলাদেবী।
কলকাতা পুলিশের কনভয় অভিজিৎকে তাঁর আবাসনের দরজায় পৌঁছে দিল রাত আটটা নাগাদ। সাদা ফুলহাতা জামা, ছাইরঙা প্যান্ট আর লাল জহরকোট পরা অভিজিৎ গাড়ি থেকে নেমে ঢুকে গেলেন ভিতরে। গলার সমস্যার জন্য তখন আর কারও সঙ্গে কথা বলতে চাননি। যদিও গোটা আবাসন গমগম করছিল শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে। অভিজিতের বন্ধু উজ্জয়ন ভট্টাচার্য, বাপ্পা সেনরা বললেন, ‘‘ও খুবই ক্লান্ত, আর চাপও ছিল। তাই ফোন করতে পারেনি। তবে আমরা তো যাবই দেখা করতে।’’ আবাসনের সম্পাদক ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় জানালেন, পরের বার কলকাতায় এলে অভিজিৎকে সংবর্ধনা দেবেন তাঁরা।
জানুয়ারির শেষে ফের শহরে আসার কথা অভিজিতের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি’লিট গ্রহণে রাজি হয়েছেন তিনি। সেই অনুযায়ী নোবেলজয়ীকে সম্মান জানানোর দিন স্থির হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy