বাম জমানার শেষপর্বে ঘূর্ণিঝড় আয়লায় বিধ্বস্ত হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশ। সেই সময়ে প্রধান বিরোধীদল হিসাবে তৃণমূল সেই দুর্যোগকে শাসক বামেদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবে ‘ব্যবহার’ করেছিল। ২০২৬ সালের ভোটের আগের বছরে উত্তরবঙ্গের দুর্যোগকেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে একই ভাবে ‘ব্যবহার’ করতে নেমেছিল বিজেপি। পরিস্থিতিসাপেক্ষে তৃণমূলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে ‘ক্ষত মেরামত’ নিয়ে। আন্দোলন এবং সমাজমাধ্যমের প্রচারকে সমান্তরাল ভাবে ব্যবহার করে এগোতে চাইছে শাসকদল। তবে মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে তৃণমূল মনে করছে, যে ‘ক্ষত’ তৈরি হয়েছিল, দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে প্রাথমিক প্রলেপ দিয়ে দিয়েছেন।
‘ক্ষত’ কী কী? প্রথমত, উত্তরবঙ্গে যখন মানুষ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সব ভেসে যাচ্ছে, তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা রেড রোডে পুজো কার্নিভালে ছিলেন। টলি এবং টেলিতারকাদের পাশে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নানা ফুটেজ, বেহালা হাতে নেওয়া ছবি ইত্যাদি তুলে ধরে সমাজমাধ্যমে প্রচার শুরু করেছিল বিজেপি-সহ বিরোধীরা। বেহালা হাতে মমতার ছবির সঙ্গে সম্রাট নিরোর ছবি পাশাপাশি রেখে প্রচার শুরু হয়েছিল। লেখা হয়েছিল, ‘রোম যখন পুড়ছিল তখন নিরো বেহালা বাজিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গ যখন ভেসে যাচ্ছে তখন মুখ্যমন্ত্রী বেহালা বাজাচ্ছেন।’
শুধু বিজেপি বা বিরোধীদের প্রচার নয়। তৃণমূলের প্রথম সারির অনেকেরই বক্তব্য, উত্তরবঙ্গের দুর্যোগের সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর কার্নিভালের বিভিন্ন ফুটেজ জনমানসে দলের সম্পর্কে ‘বিরূপ প্রতিক্রিয়া’ তৈরি করেছে। যা এড়ানো যেত। অনেকের মতে, মমতার উচিত ছিল কার্নিভালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনটুকু করে পরবর্তী দায়িত্ব মন্ত্রীদের উপর ছেড়ে দিয়ে সেদিনই উত্তরবঙ্গ রওনা হওয়া। অন্য একটি অংশের অভিমত, কার্নিভালে পুরো সময় মুখ্যমন্ত্রী হাজির থাকলেও তাঁর সেখানে ‘সক্রিয়’ যোগদান না করলেও চলত।
মঙ্গলবার অবশ্য মমতা জানিয়েছেন, রবিবার ভোর থেকেই তিনি পরিস্থিতির উপর নিজে নজর রেখেছিলেন। কার্নিভালকে ‘বাংলার গর্ব’ বলে উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘কেউ কেউ রাজনীতি শুরু করে দিয়েছেন তখন বাংলায় কেন কার্নিভাল হল? আরে, কার্নিভাল তো বাংলার গর্ব! বাংলার ক্লাবগুলো অপেক্ষা করে থাকে এর জন্য। তার কি কোনও মূল্য নেই? কোনও দুর্যোগের পর কাজ শুরু করতে ন্যূনতম সময় লাগে। সে দিন যদি আসতামও, এসে কী করতাম?’’
প্রসঙ্গত, কার্নিভালের মধ্যেও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির প্রশাসনিক কর্তা, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ রেখেছিলেন মমতা। কিন্তু সার্বিক ভাবে জনগণ তা দেখতে পায়নি। পূর্বঘোষণা মতো কার্নিভালের পরদিন, অর্থাৎ সোমবার উত্তরবঙ্গে যান মুখ্যমন্ত্রী। তবে মমতা পৌঁছোনোর আগেই তৈরি হয় দ্বিতীয় ‘ক্ষত’। জলপাইগুড়ির নাগরাকাটায় একদল মানুষের হাতে আক্রান্ত হন মালদহ উত্তরের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু। জখম হন শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর ঘোষও।
রক্তাক্ত খগেনের ছবি প্রকাশ্যে আসতেই তৃণমূলের একটি অংশ ওই ঘটনাকে ‘জনরোষ’ বলে অভিহিত করতে শুরু করে। কিন্তু মমতা উত্তরবঙ্গে পৌঁছেই বলে দেন, এই ঘটনা ‘কাম্য’ নয়। পরে ক্যামাক স্ট্রিটের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতর ওই হামলা প্রসঙ্গে দলের ‘লাইন’ নির্ধারিত করে দেয়। তার পরে থেকে গোটা তৃণমূলই বলতে শুরু করে, ‘হামলা কাম্য নয়’। পাশাপাশি মমতাও বার্তা দেন, দুর্যোগ মোকাবিলা করাই এখন একমাত্র কাজ। কেউ যেন প্ররোচনায় পা না-দেন!
ঘটনাপ্রবাহে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারাও নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বলছিলেন, ‘অস্বস্তি’ বাড়ছে। উত্তরবঙ্গ এমনিতেই বিজেপির ‘শক্তপোক্ত’ জায়গা। স্বভাবতই বিজেপি সেখানে কোমর বেঁধে নেমেছে। যা কলকাতার বিপর্যয়ের সময় দেখা যায়নি। পাশাপাশিই খগেনদের উপর হামলা তৃণমূলকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে। ওই ঘটনা নিয়ে সোমবার রাতে ‘এক্স’ হ্যান্ডলে পোস্ট করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার রাজ্যের কাছে রিপোর্ট তলব করেন লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা।
পরিস্থিতি যখন আরও ঘোরালো হতে শুরু করেছে, তখনই মঙ্গলবার দুপুরে খগেনকে দেখতে শিলিগুড়ির হাসপাতালে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। খগেনের সঙ্গে বেশ খানিক ক্ষণ কথা বলেন। জানান, খগেনের যা প্রয়োজন, তার সব বন্দোবস্ত করবে রাজ্য সরকার। পাশাপাশিই ডিভিসি-র বিরুদ্ধে পশ্চিম বর্ধমানের জেলা তৃণমূলকে আন্দোলনে নামতে নির্দেশ দেন মমতা। মন্ত্রী মলয় ঘটক, বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীরা মঙ্গলবার দুপুর থেকে অবস্থান শুরু করেন ‘রাজ্যকে না-জানিয়ে’ জল ছাড়ার প্রতিবাদে। উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় নিয়ে বিজেপি যখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব, তখন বাংলার শাসকদল সংগঠনকে নামিয়ে দেয় কেন্দ্রের বিরোধিতায়।
অনেকের মতে, মমতার হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়ায় খানিকটা হলেও দুর্যোগ-রাজনীতির মোড় ঘুরেছে। অনেকে এই ঘটনার সঙ্গে তুলনা করছেন গত বছর আরজি কর আন্দোলন পর্বের। যখন স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে নিজে থেকেই পৌঁছে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে নিজের বাড়িতে ডেকে বৈঠক, নবান্নে বৈঠক করে ধাপে ধাপে পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন ‘প্রশাসক’ মমতা।
প্রত্যাশিত ভাবেই খগেনকে দেখতে মমতা হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে তৃণমূলের নেতাদেরও মেজাজ বদলে গিয়েছে। হাসপাতালে খগেনের কেবিনে মমতার দাঁড়িয়ে থাকার ছবি পোস্ট করে তৃণমূলের নেতারা লিখতে শুরু করেছেন, ‘রাজনীতি যার যার, দিদি সবার’। কেউ লেখেন, নন্দীগ্রামে যখন মমতার পা ভেঙেছিল, তখন বিজেপি কটাক্ষ করেছিল। আর মমতা বিরোধী সাংসদকে দেখতে হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছেন। একেই বলে শিষ্টাচার।
মমতার হাসপাতালে যাওয়ার ঘটনা এতটাই আচম্বিতে ঘটেছে যে, বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরাও খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছন। অনেকে তো এমনও বলতে শুরু করেছেন যে, রাজনীতি ‘শিখতে হয়’। রবিবার উত্তরবঙ্গে দুর্যোগের সময় কার্নিভালে মমতার ছবিকে ‘হাতিয়ার’ করেছিল বিজেপি-সহ বিরোধীরা। মঙ্গলবার শিলিগুড়ির হাসপাতালে জখম বিজেপি সাংসদকে মমতার দেখতে যাওয়ার ছবিকে ‘পাল্টা অস্ত্র’ করেছে তৃণমূল।
উত্তরবঙ্গের আবহাওয়া পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তবে দুর্যোগ এবং বিপর্যয়ের ছাপ দগদগে। মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের। এখনও অনেকে নিখোঁজ। ক্ষতি হয়েছে বিপুল। ভরা মরসুমে সঙ্কটে পর্যটন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে দুর্যোগধস্ত এলাকা। দুর্যোগের রেশ ভোট পর্যন্ত থাকবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে রবিবার থেকে যে ‘দুর্যোগ রাজনীতি’ শুরু হয়েছিল, তাতে খানিকটা শাসকদল যে খানিকটা প্রলেপ দিতে পেরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই।