ফুটপাতে পসরা। তাই বাসিন্দাদের হাঁটতে হচ্ছে রাস্তা দিয়ে। শিলিগুড়ির বিধান রোডে। —নিজস্ব চিত্র।
শিলিগুড়ি কার, তাড়া করে এই প্রশ্নটাই
এক সময়ে সন্ধ্যে হলেই শহরে শেয়ালের ডাক শোনা যেত। গরুর গাড়িতে পাট নিয়ে আসা হতো শহরের গুদামে। আমাদের বাড়ি বর্ধমান রোডে। বর্তমানে ঝংকার মোড়। আগে পরিচিত ছিল র্যালিগোলা মোড় নামে। কারণ ঝংকার সিনেমা হল আর সামনের মাঠ নিয়ে ছিল র্যালি ব্রাদার্সের পাটের গোলা। সেখানেই ছোটবেলায় গরুর গাড়ি আসতে দেখেছি। চা, পান, মুদির দোকানও ছিল। ওই মোড় ঘিরেই দিনভর জটলা লেগে থাকত। সন্ধ্যার আড্ডাও চলত মোড়ে। তখন ১৯৬০ সাল। চিনের সঙ্গে তখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি। গ্রামে যেমন কোনও দোকানকে ঘিরে মজলিশি ঢঙে আড্ডা চলে, তত্কালীন শিলিগুড়ির চালচিত্রও ছিল অনেকটা সে রকমই।
যতদূর জানি, ঝংকার মোড়েই ছিল শিলিগুড়ির অন্যতম পুরোনো পাবলিক লাইব্রেরি। নাম ছিল সুভাষ পাঠচক্র। ১৯৪৯ সালে স্থাপিত সেই লাইব্রেরির সিল মারা কয়েকটি বই এখনও আমার কাছে আছে। ১৯৬২ সালে চিন যুদ্ধের সময়ে রাস্তা চওড়া করার জন্য লাইব্রেরিটি সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে অন্য কোথাও কেন সেই লাইব্রেরিকে স্থানান্তর করা হয়নি তা জানার বয়স তখনও আমার হয়নি।
মনে আছে, ছোটবেলায় বাবা আমাদের ‘গোসেইন’ নামে একটি বইয়ের দোকানে বসিয়ে রাখতেন। সেই দোকানটি ছিল হিলকার্ট রোডের ধারে, বর্তমানে সেখানে যাদব সমিতির ভবন রয়েছে। সামনে দিয়ে কু ঝিক ঝিক শব্দে ছোট রেলগাড়ি চলে যেত। হিলকার্ট রোড ধরে চলা সেই ছোট রেলগাড়ি বা টয়ট্রেন দেখার আকর্ষণ তো ছিলন, তা ছাড়া দোকানে আমাদের বসিয়ে রাখা হতো, যাতে লোকজন দেখে সময় কেটে যায়। ওই এলাকাটিই তখন জমজমাট ছিল। মসজিদের আশেপাশে তখন জামাকাপড়ের বড় বড় দোকান। তখনও কিন্তু বিধান মার্কেট গড়ে ওঠেনি।
চিনের সঙ্গে যুদ্ধ কিন্তু শিলিগুড়ির কাছে শাপে বর হয়েছিল। সেনাবাহিনীর চলাচলের জন্য রাস্তা সম্প্রসারণের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। হিলকার্ট রোড, বর্ধমান রোড, স্টেশন ফিডার রোড চওড়া করা শুরু হল। রাস্তার আশেপাশের দোকান সরানোর কাজও শুরু হল। কিন্তু দোকান সরে যাবে কোথায়? বিভিন্ন গুমটিঘর সরিয়ে, ব্যবসায়ীদের পুর্নবাসন দেওয়ার জন্য তৈরি হল বিধান মার্কেট। শুধুমাত্র হাঁটার উপযুক্ত ছোট্ট রাস্তা চওড়া করে তৈরি হল বিধান রোড। তখন প্রতিদিনই শিলিগুড়ি একটি করে বেড়ে উঠছে। বৃদ্ধি আরও গতি পেল ১৯৬৫ সালের পর। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় থেকে। সে সময়ের শিলিগুড়ি দেখল ব্ল্যাক আউট, কাটা হল ট্রেঞ্চ, তৈরি হল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। হঠাত্ করে বোমা পড়া শুরু হলে, কী করতে হবে তার প্রশিক্ষণ শুরু হল। একধাপে শিলিগুড়ি অনেকটাই সাবালক হল। অনান্য শহরকে পেছনে ফেলে দ্রুত উত্থান শুরু হল মহকুমা শহর শিলিগুড়ির।
এই সময়ে কিছুটা ভৌগোলিক কারণেই, কিছুটা তত্কালীন বিধায়ক যিনি নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর চেষ্টায় শহরের উন্নতি এগিয়ে যেতে থাকল। গড়ে উঠল হাসপাতাল, অতিরিক্ত জেলা গ্রন্থাগার, আদালত। যদিও সবেরই আগে অতিরিক্ত শব্দটা বহাল থাকল।
তাতে অবশ্য কোনও সমস্যা নেই। নামে কি বা যায় আসে। ধীরে ধীরে হিলকার্ট রোডের ধারে লোহার জালি ঘেরা পুরসভা থেকে পুর কর্পোরেশনে উত্তরণ ঘটল। শিলিগুড়িকে আলাদা জেলা ঘোষণা করার দাবি তুলেছেন অনেকেই। কিন্তু আমাদের জেলার নাম পৃথিবী বিখ্যাত। আর কলকাতার পরেই রাজ্যের বড় শহর শিলিগুড়ি। সেটাও কম বড় কথা নয়। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগ লাঘব করতে ভক্তিনগর থানা এলাকাকে শিলিগুড়ির সঙ্গে স্থায়ী ভাবে জুড়ে দেওয়া হোক।
কিন্তু একটা প্রশ্ন আমাদের তাড়া করে। শিলিগুড়ি তুমি কার? কোনও নিয়ম আইনের পরোয়া না করা কিছু ব্যক্তির কী? কারণ রাস্তার উপরেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে পাকা দোকান ঘর। দেখার কথা কার? এক দিন বাইক দাঁড় করিয়ে বিধানরোডে ফল কিনতে যাব, সে সময়েই ট্র্যাফিক পুলিশ রে রে করে তেড়ে এলেন। তাঁকে বললাম, আর যারা রাস্তা পাকাপাকি ভাবে দখল করছে তাদের বেলায়? বলাই বাহুল্য কোনও উত্তর পেলাম না। ফুটপাথ দখল করে দোকান বসার কারণে সেবক রোড, হিলকার্ট রোড, বিধান রোড দিয়ে যাতায়াত করাই দুর্ভোগের।
তাই শিলিগুড়ি কার, এই প্রশ্নটাই আমার মতো ভূমিপুত্রদের তাড়া করে। একে বড় দোকান রাস্তা দখল করছে, তার উপরে ভ্যান, ঠেলা এমনকী ছাতা লাগিয়েও ফুটপাথ দখল হয়ে গিয়েছে। উত্তরবঙ্গের অন্যতম বড় বাস টার্মিনাস থেকে গাড়ি বের হওয়ার পথই মেলে না। ওই রাস্তা দিয়েই শিলিগুড়ি জংশন স্টেশনে যেতে হয়। সে পথও নিয়মিত জটে অবরূদ্ধ থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিবেদিতা রোডের উপরেই দিব্যি প্রতিদিন বাজার বসে। ওই রাস্তা দিয়ে প্রতিবারই যাওয়ার সময়ে মনে হয়, আমরা যে শহরে থাকি সেখানে পুরসভা বলে কি কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে? নাকি সবটাই ভোটের জন্য সস্তা রাজনীতি।
মহাবীরস্থান উড়ালপুলের নীচে একের পর এক দোকান গজিয়ে উঠেছে। ওই এলাকা নির্ধারিত হয়েছিল পার্কিঙের জন্য। সে জায়গা বেদখল হওয়ার কারণেই ব্যস্ত রাস্তাতেই অবাধে পার্কিং চলছে। যার অবধারিত ফল যানজট।
বাইরে থেকে চাকরি বা ব্যবসা সূত্রে শিলিগুড়ি উপাজর্ন করতে আসা ব্যক্তিরাই আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের শহরের প্রতি কোনও টান তৈরি হচ্ছে না। সে কারণেই শিলিগুড়ির এই অবস্থা। বেসরকারি ভাবে অন্তত দশ লক্ষ লোকের শিলিগুড়ি শহরে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ৪ লক্ষ যানবাহন চলাচল করে। তার ফলেই শিলিগুড়ি ক্রমশ অবরূদ্ধ হয়ে পড়ছে। এখনই কোনও ব্যবস্থা না নিলে এক দিন হয়তো এমনও আসবে যখন শহরের রাস্তা জুড়ে গাড়ির পরে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে। ভোটের জুজুর ভয়ে পুরসভা বা কোনও জনপ্রতিনিধিই অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে চান না। সে জন্য চাই এক শক্তিশালী নাগরিক সমাজ। তাদেরও উদ্যোগী হতে হবে। আসুন, আমরা আমাদের প্রিয় শহরটাকে নিয়ে ভাবি, আমার শহরকে আমাদের শহর হিসেবে গড়ে তুলি।
মানস তরফদার। প্রাক্তন সম্পাদক, উত্তরবঙ্গ বইমেলা কমিটি, বিদ্যাসাগর পল্লি। শিলিগুড়ি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy