‘নিশ্চয়যানে’র নাম শুনেছেন? হাঁ করে থাকেন মাঝিয়া বিবি। “মাতৃযান’? এ বারে ফিক করে হেসে ফেলেন। ঘোমটার কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে হাসি আড়াল করে বলেন, “কী যে কন তোমরা? মুই জানং না।”
অবশ্য জানারও কথা নয়, কোচবিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম দিনহাটার জারিধরলা, দরিবসের মানুষদের কাছে এখনও ভরসা বাংলাদেশ। রাত-বিরেতে প্রসব বেদনায় কেউ কাতর হলে নিশ্চয়যানের খোঁজ করেন না কেউ। সোজা চলে যান বাংলাদেশের মোগলহাটে। সেখানেই চিকিৎসক দেখিয়ে ঘরে ফেরেন তাঁরা। কখনও কখনও সেখানে থেকেই চলে চিকিৎসা। মাঝিয়া বলেন, “শরীর খারাপ হলে তো বাংলাদেশেই যেতে হয়। বাড়ির অনেকটা কাছে পড়ে। চট করে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরতে পারি।”
ওই গ্রামের মানুষেরা যে বিপদে পড়লে বাংলাদেশে চলে যান সে খোঁজ রাখেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। কয়েক মাস আগেই বন্যায় ধরলা নদীর জলে গোটা গ্রাম ডুবে যায়। তল্পিতল্পা গুটিয়ে সাড়ে হাজার মানুষ আশ্রয় নেন বাংলাদেশে। মন্ত্রী সেখানে গিয়ে সব জানতে পারেন। তিনি বলেন, “ওই গ্রামে যেতে একটি নদী পড়ে। তার পরেও অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। তাই বন্যার সময় অসুবিধেয় পড়ে বাসিন্দারা বাংলাদেশ চলে যান। ওই দেশও মানবিকতার সঙ্গে বিষয়টি দেখেন। তবে গ্রামের উন্নয়নে একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।” গ্রামের এক পঞ্চায়েত সদস্য তথা গীতালদহ ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান আমিনুল হক বলেন, “মানুষদের বাংলাদেশ যাওয়া ছাড়া অনেক সময় উপায় থাকে না। তা আমরা সবাই জানি। বেঁচে থাকার লড়াইকে সবাই মানবিকতার সঙ্গে দেখেন।”
কেমন ওই দু’টি গ্রাম? দিনহাটা মহকুমার বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া প্রত্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত গীতালদহের মধ্যে পড়ে জারিধরলা, দরিবস। গীতালদহ বাজার থেকে নদী পেরিয়ে বালু চর ধরে প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটা পথের পরেই ওই দুটি গ্রাম। সব মিলিয়ে গ্রামের জনসংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। নদী পার হওয়ার মুখে বিএসএফের নজরদারির মধ্যে পড়তে হয় তাঁদের। পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবেই মেলে যাতায়াতের অনুমতি। নদীর পার হলে কার্যত তাঁরা বাংলাদেশে চলে যান বলেই ধরে নেওয়া হয়। গ্রামে কোনও চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। মাসে একবার স্বাস্থ্যকর্মীরা খোঁজ নিতে যান। হাইস্কুল নেই। ওই গ্রাম দু’টি থেকে বাংলাদেশের মোগলহাটের দূরত্ব বড় জোর দুই কিলোমিটার। বাসিন্দারা জানান, মাস কয়েক আগে দুই মহিলা লালমণিরহাটে এক চিকিৎসাকেন্দ্রে দু’টি শিশুর জন্ম দেন। আবার ডাকলে গ্রামেই হাতুড়ে চিকিৎসক বাংলাদেশ থেকে চলে আসে। বাড়িতেও ওই চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে প্রসূতির চিকিৎসা হয়।
মোগলহাট, দুর্গাপুরে বাজার বসে। সেখানে চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে এলে কোনও কাজে সেদিকেই যান তাঁরা। গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, “রাতে কেউ অসুস্থ হলে তো অনেক অসুবিধে। গীতালদহ বা দিনহাটায় নিয়ে যেতে হলে বিএসএফের অনুমতি নিতে হবে। তারপরে গাড়ি মেলে না। কোলে করেই রোগীকে নিয়ে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটতে হয়। তাই আমরা রাতে নদী পার হওয়ার কথা ভাবি না।” বিএসএফ অবশ্য দাবি করেছে, তাঁরা কড়া নজরদারি রাখেন। ওপারে যাওয়ার খবর তাঁদের কাছে নেই।