অবশেষে আবার স্বপ্ন দেখা। জেগে ওঠা যেন আবারও। সব ঠিকঠাক থাকলে, দীর্ঘ এক দশক বন্ধ থাকার পরে ফের খুলতে চলেছে জলপাইগুড়ির চা নিলাম কেন্দ্র। পাতার জোগান কম থাকায় ২০১৫ সালে যখন নিলাম কেন্দ্র বন্ধ হয়, তখন হতাশ হয়েছিলাম আমরা সকলেই। মনে হয়েছিল, চিরদিনের বঞ্চিত উত্তরবঙ্গের মুকুট থেকে, শুকনো চা-পাতার মতোই আর একটি পালক ঝরে গেল।
অথচ পশ্চিমবঙ্গের মোট চা উৎপাদনের ২২ শতাংশ আসে জলপাইগুড়ি জেলার ক্ষুদ্র চা চাষিদের হাত ধরে। ৬ হাজার ২৪৫ বর্গ কিলোমিটার এই জেলায় চা বাগানের অংশ ১ হাজার ৯৮৭ বর্গ কিলোমিটার। আলিপুরদুয়ার জেলা যোগ করলে সারা ভারতের চা উৎপাদনের ১৮ শতাংশ চা হয় এখানেই। দুই জেলার ৯৬টি বৃহৎ চা বাগান আর ৯৮টি বটলিফ কারখানা ২৩০ মিলিয়ন কেজি চা সরবরাহ করে। আর সমগ্র ডুয়ার্স ধরলে উৎপাদন দাঁড়ায় দেশের মোট উৎপাদনের ২৫ শতাংশ। চা বাগানের সংখ্যা ২৩৫টি আর ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৮১ হাজার ৩৩৮ একর।
জলপাইগুড়ি যেহেতু ডুয়ার্স ও কোচবিহারের সমতলভূমির কেন্দ্রে, তাই সঙ্গত কারণেই এখানে চা নিলাম কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। প্রথম দিকে সম্ভাবনা জাগিয়ে তুললেও, সেটি যখন বন্ধ হয়ে যায়, অবাক হয়েছিলাম। অথচ উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চল চা উৎপাদনের জন্য বিশ্ব মানচিত্রে পরিচিত। যদিও এই দেশে প্রথম চা চাষের কৃতিত্ব অসমের। সেখানে ১৮২৩ সালে মেজর রবার্ট ব্রুসের চা গাছ আবিষ্কারের ১৮ বছর পরে, দার্জিলিংয়ে চা চাষের সম্ভাবনা দেখা যায়। ডক্টর ক্যাম্বেলের পোঁতা চা গাছ যখন দ্রুত বেড়ে ওঠে, তখনই বোঝা যায় এখানকার আবহাওয়া চা চাষের অনুকূল। ফলে ধুরন্ধর ইংরেজরা আর দেরি করেননি। চা চাষের জন্য তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। পথ দেখান দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন মেজর গ্রামলিন। তিনি লেবংয়ে উত্তরবঙ্গের প্রথম চা বাগান তৈরি করেন। ১৮৫৬ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে দার্জিলিং পাহাড়ে ৯১টি চা বাগান তৈরি হয়।
তুলনায় উত্তরের সমতলে চা আসে কিছুটা পরে। ১৮৭৪ সালে। জলপাইগুড়ির গজলডোবায় ডব্লু ব্যারেন্টির চা বাগান সফল হলে, ‘টি প্ল্যান্টার্সদের’ নজর পরে অরণ্যে ঢাকা ডুয়ার্সের দিকে। দ্রুত সবুজ চা বাগানে ঢেকে যায় চারদিক। চা বাগান কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রায় উনিশটি জনপদ। অসম-সহ উত্তরবঙ্গের ২ লক্ষ ১০ হাজার একর জমি চা বাগানে পরিণত হয়। ‘টি, টিম্বার, টুরিজমের’ ভূমি বলে পরিচিত হলেও, উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে চা। ইউরোপিয়ান চা ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি, পিছিয়ে ছিলেন না দেশীয় শিল্পপতিরাও। এখনও কান পাতলে শোনা যায় রায়কত পরিবার, যোগেশচন্দ্র ঘোষ, মুন্সি রহিম বক্সের মতো প্রসিদ্ধ চা শিল্পপতির নাম।
তাঁদের সবারই বাসস্থান হয়ে উঠেছিল ১৮৬৯ সালে গঠিত জলপাইগুড়ি জেলা। তাই জলপাইগুড়ির মতো শহরে চা নিলাম কেন্দ্র তৈরি হওয়া ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। তা হয়েছিলও। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। ফলে তার নতুন করে পথচলা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আনন্দের। আরও আশার কথা, মহড়া নিলামে আট জন ব্রোকার, ৪৭ জন ক্রেতা এবং প্রতি কেজি চায়ের দাম ৫৩২ টাকা উঠেছে। এই বিষয়টিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সদিচ্ছা আর পূর্ণ শ্রম যদি থাকে, তবে দেশের অন্যতম অগ্রণী চা নিলাম কেন্দ্র হতে জলপাইগুড়ি সময় নেবে না, সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
শিক্ষক, কোচবিহারের বাসিন্দা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)