Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

যত দামই দিন, এই মাছ শুধু বৌমার

শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে ফাঁসিদেওয়ার রাঙাপানির বাসিন্দা সুন্দরলালবাবুর অপত্যস্নেহের কাহিনি তাই মুখে মুখে ফিরছে এলাকায়। কারণ, অনেকে সাহায্যের প্রস্তাব দিলেও তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন ওই প্রৌঢ়।

একাগ্র: বৌমার জন্য লচকা নদীতে নেমে মাছ ধরছেন সুন্দরলাল সিংহ। শনিবার ফাঁসিদেওয়ায়। —নিজস্ব চিত্র।

একাগ্র: বৌমার জন্য লচকা নদীতে নেমে মাছ ধরছেন সুন্দরলাল সিংহ। শনিবার ফাঁসিদেওয়ায়। —নিজস্ব চিত্র।

কিশোর সাহা
ফাঁসিদেওয়া (শিলিগুড়ি) শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৪৮
Share: Save:

রক্তাল্পতায় ভোগা সদ্য মা হওয়া পুত্রবধূকে টাটকা মাছের ঝোল খাওয়ানোর নিদান দিয়েছেন ডাক্তার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় যে সংসারে, সেখানে মাছ কিনে খাওয়ানোর উপায় কী! তাই কনকনে শীতেও টানা ৩ ঘণ্টা লচকা নদীর কোমর জলে থেকে জাল ফেলে মাছ ধরেন ৫৬ বছর বয়সী সুন্দরলাল সিংহ।

শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে ফাঁসিদেওয়ার রাঙাপানির বাসিন্দা সুন্দরলালবাবুর অপত্যস্নেহের কাহিনি তাই মুখে মুখে ফিরছে এলাকায়। কারণ, অনেকে সাহায্যের প্রস্তাব দিলেও তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন ওই প্রৌঢ়। তিনি বলেছেন, ‘‘বৌমা তো আমার মেয়ের মতোই। মেয়েকে বাঁচাতে এটুকু কষ্ট করতে পারব না! তাই লোকের কাছ থেকে হাত পেতে সাহায্য নিতে পারব না।’’

শিলিগুড়ি থেকে নৌকোঘাট পেরিয়ে ফাঁসিদেওয়ার দিকে কয়েক কিলোমিটার এগোতেই তিরতিরে জলের লচকা নদী। বুধবার সেখানেই দেখা মিলল সুন্দরলালবাবুর। পেশায় রাজমিস্ত্রি। প্রৌঢ় থাকেন রাঙাপানির রেলগেটের অদূরে। আপাতত টানা কাজকর্ম করতে পারেন না। তাঁর একমাত্র ছেলে বাপিও দৈনিক হাজিরায় ছোটখাট কাজ করেন। ২১ বছর বয়সী পুত্রবধূ নন্দনী মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। নাতিকে দেখতে গেলে চিকিৎসক ওই প্রৌঢ়কে পরামর্শ দেন, রক্তাপ্লতার কারণে প্রসূতিকে নিয়মিত টাটকা মাছের ঝোল খাওয়ানো জরুরি।

কিন্তু, টাটকা মাছের তো দাম অনেক। তাও চাষের মাছে থাকে নানা ধরনের ওষুধও। ছেলের যা আয় তা ডাল-ভাত জোগাড়েই ফুরিয়ে যায়। তাই সাত সকালেই জাল হাতে লচকায় নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রৌঢ় মানুষটি। পানা-শ্যাওলা সরিয়ে জালে একবারে ৫-৭টার বেশি মাছ ওঠে না। হাল না ছেড়ে ঘণ্টা তিনেক চেষ্টা চালিয়ে ৭৫০ গ্রাম মাছ ধরেছেন প্রৌঢ়। টাটকা মাছ দেখে তা কিনতে গাড়ি, বাইক থামিয়ে হাজিরও হন দু-চারজন। কিন্তু, জোড় হাতে তাঁদের সুন্দরলালবাবু জানিয়ে দেন, ‘‘স্যার, যত দামই দিন, এটা বিক্রি করতে পারব না। এটা আমার বউমার জন্য। আমরাও খাব না।’’

লচকার ধারেই দেখা মিলল এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যা পার্বতী রায়ের স্বামী জগদীশবাবুর। তিনি বললেন, ‘‘ছেলে-বউয়ের সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির মতের মিল না হওয়ার ঘটনা এখন প্রায় ঘরেই। সেখানে ছেলের বউয়ের জন্য এমন কষ্ট স্বীকার করে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় ৩-৪ ঘণ্টা কোমর জলে থেকে মাছ ধরার ঘটনা আগে দেখিনি।’’ তাঁকে মাছ খাওয়ানোর জন্য শ্বশুরের এমন কষ্ট স্বীকারের কথা শুনে আঁচল দিয়ে চোখ মুছেছেন নন্দনী। ছেলে বাপি বলেছেন, ‘‘এমন বাবা পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার।’’

তবে গ্রামবাসীদের আলোচনায় এটাও উঠছে, আগামী দিনে বৃদ্ধ হলে বাবাকে ছেলে-বউ দেখবে তো! যা শোনার পরে প্রৌঢ় মাছের চুপড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়ে বললেন, ‘‘দু-ক্রোশ হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। দুপুরের মধ্যে রান্না করে খাবার মেডিক্যালে পৌঁছতেই হবে। বাকি কথা না হয় পরে একদিন বলা যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

daughter in law Elderly
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE