Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

তিস্তা-করলা ঘেরা শহর যেন এক টুকরো বিলেত

লন্ডনের রাস্তার পাশে ওক, ম্যাপল। জলপাইগুড়ির ছিল কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূ়ড়া, কাঞ্চন। বর্ষায় আর বসন্তে কালো পিচের রাস্তা ঢেকে দিত তারা।

জীর্ণ: জলপাইগুড়িতে ইওরোপিয়ান ক্লাবের ভবন। নিজস্ব চিত্র

জীর্ণ: জলপাইগুড়িতে ইওরোপিয়ান ক্লাবের ভবন। নিজস্ব চিত্র

অনির্বাণ রায়
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:২২
Share: Save:

লন্ডনের রাস্তার পাশে ওক, ম্যাপল। জলপাইগুড়ির ছিল কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূ়ড়া, কাঞ্চন। বর্ষায় আর বসন্তে কালো পিচের রাস্তা ঢেকে দিত তারা।

টেমসের মতো করলা নদীও এই শহরকে জড়িয়ে বয়েছে। শহরের গবেষকদের অনেকেই মনে করেন, এ সব অনুষঙ্গ দেখেই দেড়শো বছর আগে ব্রিটিশ প্রশাসকরা জলপাইগুড়ি শহরকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। যে বছর লন্ডনের টেমস নদীর ওপরে টাওয়ার ব্রিজ উদ্বোধন হল, সে বছরই প্রথম দরজা খুলল করলা নদীর পাশে ইউরোপিয়ান ক্লাবের। দেড়শো বছর পেরিয়ে সেই লালবাড়ি এখন ভগ্নপ্রায়। ক্লাবের মতোই শতবর্ষ পেরোনো অন্য ভবনগুলিও ভেঙে পড়ার অপেক্ষায়।

ইউরোপিয়ান ক্লাব তৈরির পরেই জলপাইগুড়ি শহর ব্রিটিশ আভিজাত্যের পরিধিতে ঢুকে পড়ে বলে গবেষকেরা দাবি করেন। শহরে আনাগানো শুরু হয় ব্রিটিশ শিল্পপতি, প্রশাসকদের। তখন পিয়ানোর সুর, পানপাত্রের টুংটাং আর কেক, পেস্ট্রির গন্ধে ম ম করত গোটা এলাকা। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, “ইংরেজ আমলে জলপাইগুড়ি ছিল যেন এক টুকরো বিলেত। ইউরোপিয়ান ক্লাবে টেনিস কোর্ট ছিল। চা বাগানের সাহেব মালিকেরা বিলিয়ার্ড খেলতে ডুয়ার্স থেকে জলপাইগুড়িতে আসতেন।”

ইউরোপিয়ান ক্লাবের কিছুটা দূরেই ছিল রেসকোর্স। ঘোড়দৌড় হত শহরের রাজপথে। এখনও সেই এলাকা রেসকোর্স পাড়া নামেই পরিচিত। দোতলা ক্লাবের ওপরে পাঁচটি ঘর। সেখানে শিল্পপতি থেকে আমলারা এসে থাকতেন। নীচের তলায় রয়েছে পানশালা। দামী ঝাড়বাড়ি, সেগুন কাঠের চেয়ার। রূপোর পানপাত্রে পরিবেশন করা হতো স্কটল্যান্ড থেকে আসা পানীয়। ক্লাবের মাথায় উড়ত লাল-সাদা ইউনিয়ন জ্যাক। জেলার ইতিহাস নিয়ে একাধিক বইয়ের লেখক উমেশ শর্মার কথায়, “পুরো এলাকাটি সাহেবপাড়া নামে পরিচিত ছিল। ও দিকে ভারতীয়দের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। শোনা যায়, বড়দিন, নিউ ইয়ারে শহর জুড়ে আলোর মালা সাজত। সাহেব-মেমরা রাজপথে নানা উৎসবও করতেন।” তখন থেকেই শহরে শিল্পপতিরা থাকতে শুরু করেছিলেন। বিকেলে হাতি নিয়ে তিস্তা অথবা করলার পাড়ে বেড়ানো সাহেবদের প্রিয় শখ ছিল। যার প্রমাণ রয়েছে ১৩০ বছর পেরিয়ে আসা পুরসভার নথিতেও। কারও হাতি যেন রাস্তার দু পাশের গাছ নষ্ট না করে তার নজরদারির নির্দেশের উল্লেখ রয়েছে পুরসভার পুরনো নথিতে। কোচবিহারের হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার বলেন, “জলপাইগুড়ির কোনও হেরিটেজ ভবনই সে ভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি, এটাই আক্ষেপ।”

জেলার দেড়শো বছর পূর্তি উৎসব শুরু হয়েছে। শহরে ম্যারাথন থেকে আতসবাজির প্রদর্শনী নানা অনুষ্ঠান চলছে। সে উৎসবেরও সাক্ষী থাকল প্রতিদিন একটু একটু করে পলেস্তার খসে পড়া ইউরোপিয়ান ক্লাবের পেল্লায় বাড়ি। জরাজীর্ণ হয়ে রয়েছে আইটিপিএ ভবন। বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়িও ভগ্নপ্রায়। সংরক্ষণের অভাবে জেলার দেড়শো বছরে ভগ্নপ্রায় সব স্থাপত্যই। স্মৃতি বুকে নিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Heritage Building Jalpaiguri Colonial Structures
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE