ছিল আম। হয়ে গেল আমসত্ত্ব। মালদহে চলছে আমসত্ত্ব তৈরির কাজ। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।
মালদহের মকদমপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছিলেন দিল্লির বাসিন্দা আনন্দমোহন ঘোষ। পরের দিনই তিনি চলে আসেন শহরের চিত্তরঞ্জন মার্কেটের এক কোণে থাকা সনাতন দাসের আমসত্ত্বের দোকানে। দোকানে এখন অবশ্য তার ছেলে ডালিম বসে। আনন্দবাবু তার কাছ থেকে প্রায় পাঁচ কেজি গোপালভোগ ও হিমসাগর আমের আমসত্ত্ব কেনেন। আনন্দবাবুর কথায়, বাড়ির জন্য এক কেজি রেখে বাকি চার কেজিই পাঠাতে হবে ইংল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে দুই বন্ধুর কাছে। মালদহে আসছি শুনে বন্ধুরা আগে থেকেই আমসত্ত্বের বায়না করে রেখেছিল।
সত্যি বলতে কী, মালদহের আমসত্ত্ব লা-জবাব। আম সারাবছর না পেলেও আমসত্ত্ব দুধে গলিয়ে সারা বছরই আমের স্বাদ মেলে। তাই এর কদর। ব্যবসার কাজে বাংলাদেশের ঢাকা থেকে মাঝেমধ্যেই মালদহে আসেন আব্দুল ওয়াহেদ। যতবারই তিনি আসুন না কেন, আমসত্ত্ব কেনা চাই-ই। তিনি বলেন, এই আমসত্ত্ব সারা বছরই আমাকে ও আমার পরিবারকে আমের স্বাদে মাতোয়ারা করে রাখে। শুধু আনন্দবাবু বা ওয়াহেদ সাহেবই নন, মালদহে বেড়াতে এসেছেন, অথচ আমসত্ত্ব কেনেননি— এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। তাই আমসত্ত্বের চাহিদা বছরভরই থাকে। শুধু আমসত্ত্বই নয়, মালদহে থাকা বেশ কয়েকটি কোম্পানির আমের আচার, আম কাসুন্দি, আম সরষে, জেলি, জ্যামেরও চাহিদা রয়েছে। এই রাজ্য তো বটেই, ভিন রাজ্যে, এমনকী ভিন দেশেও। কয়েক বছর আগে অবশ্য মালদহের একটি কোম্পানির আচার ইউরোপের দেশগুলিতে রফতানি হতো। কিন্তু তা এখন বন্ধ রয়েছে।
মালদহের বিখ্যাত আমসত্ত্ব এ ভাবে এর-ওর হাত ধরাধরি করে বিদেশে গেলেও ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এখনও কিন্তু তা বিদেশে পাড়ি দেয়নি। কিন্তু কেন? জেলারই এক রফতানিকারক উজ্জ্বল সাহা বলেন, মালদহের আমসত্ত্ব উৎকৃষ্ট মানের হলেও তা রফতানির উপযুক্ত নয়। সেটাকে বিদেশের বাজারে পাঠাতে যে মান বজায় রাখা দরকার, তা যাঁরা তৈরি করেন তাঁরা জানেন না। ফলে একটা সমস্যা হয়ে রয়েছে। মালদহের উত্তর জোত গ্রামের আমসত্ত্বের কারিগর সৌভিক দাস, ভারতী দাস, আলো রায়, সেন্টু রায়রা অবশ্য বলেন, আমসত্ত্ব তৈরির কাজ সহজ নয়। ভাল রোদ না থাকলে তা তৈরি করা কঠিন। শুধু তাই নয়, আমসত্ত্ব খুবই স্পর্শকাতর। তা শুকোনোর সময় একটু জল পড়লেই রং কালো হয়ে যাবে। যে হেতু আমসত্ত্ব শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ, সকলেই ভালবাসেন, তাই তা সংরক্ষণের জন্য কোনও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। সংরক্ষণের একমাত্র উপায় বারবার রোদে দেওয়া। আমরা যা উৎপাদন করি, তার সবটাই বিক্রি হয়ে যায়। বাইরের ও জেলার মানুষের কাছে গোপালভোগ ও হিমসাগর আমের তৈরি আমসত্ত্বেরই চাহিদা বেশি। তবে মেঘলাল, ভারতী, দুই কোম়র, গঙ্গাপ্রসাদ, কিষাণভোগ, রাখালভোগ, জহরী, ওলটকমলের মতো স্থানীয় আমের তৈরি আমসত্ত্বের চাহিদা রয়েছে। এখনও কোনও সংস্থা আসেনি যারা আমসত্ত্বকে রফতানিযোগ্য করে বিদেশে পাঠাতে পারে।
তবে বাণিজ্যিক ভাবে বিদেশে না গেলেও এ বার দিল্লির জনপথে রাজ্য সরকারের তরফে যে আম মেলা হয়েছিল, সেখানে মালদহ জেলা উদ্যানপালন দফতর প্রায় এক কুইন্টাল আমসত্ত্ব নিয়ে গিয়েছিল। সবটাই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। জেলা উদ্যান পালন দফতরের আধিকারিক রাহুল চক্রবর্তীর কথায়, গত কয়েক বছর ধরেই দিল্লিতে আম মেলায় মালদহের আম নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ বারই প্রথম আমসত্ত্বও নিয়ে যাওয়া হল। আমরা ভাবতেই পারিনি যে আমসত্ত্বের এমন মারাত্মক চাহিদা হবে। জানলে আরও বেশি করে নিয়ে যেতে পারতাম। তবে আশার কথা হল, আগামী বছর জুনে আম মেলা থাকলেও এখন থেকেই আমসত্ত্বের বরাত পেতে শুরু করেছি আমরা।
আমসত্ত্বের পাশাপাশি মালদহের আমের আচার, আম কাসুন্দি, আম পানা, জ্যামেরও কিন্তু চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। আমজাত পণ্য উৎপাদনে জেলায় বেশ কয়েকটি কারখানাও চালু হয়েছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে পাড়ি না দিলেও এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে শুরু করে ভিন রাজ্যেও পাড়ি দিচ্ছে।
আর মালদহের আমের চাহিদা তো রয়েছেই। এ বার ‘অফ ইয়ার’ বা আম ফলনে মন্দার বছর হওয়ায় জেলায় আমের ফলন প্রায় এক হাজার মেট্রিক টন কম হয়েছে। তবে এ বার আমচাষিরা আমের ঠিকঠাক দাম পেয়েছেন। বিশেষ করে মালদহের বিখ্যাত ল্যাংড়া, হিমসাগর, আম্রপালী, লক্ষ্মণভোগ, ফজলির দাম ভালই মিলেছে। দিল্লির বাজারেও ওই আমগুলি সমাদৃত হয়েছে। আগামী বছর ‘অন ইয়ার’। আমের রেকর্ড ফলনের আশায় এখন থেকেই দিন গুনছেন আম চাষিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy