E-Paper

মুঠোফোনের ইমোজির যুগে হারাচ্ছে ‘শ্রীচরণেষু’

তাই তো নববর্ষে বা বিজয়া দশমীতে প্রিয়জনের চিঠির জন্য হাপিত্যেস করে আজ আর কেউ বসে থাকেন না।

শঙ্খনাদ আচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:১৩
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণের অহোমরাজ স্বর্গনারায়ণকে লেখা চিঠি বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে (যদিও বহু সমালোচক এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন)। অর্থাৎ যে চিঠি-র উপরে ভর করে বাংলা গদ্য সাহিত্যের পথ চলা শুরু হয়েছিল, প্রযুক্তির ঘেরাটোপে সেই চিঠি লেখার চল আজ প্রায় উঠেই গিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র দেড় দশক আগেও কাছের-দূরের মানুষের সঙ্গে সংবাদ আদানপ্রদানের জন্য আমজনতার একমাত্র ভরসা ছিল চিঠি। অন্য অনেকের মতো আমাদের বাড়িতেও প্রতি বছর নববর্ষে বা বিজয়া দশমীতে নিয়ম করে চিঠি লিখতে হত। বেশিরভাগ চিঠিই শুরু করতে হতো ‘শ্রীচরণেষু’ বা ‘শ্রীচরণকমলেষু’ দিয়ে। ল্যান্ডফোন বা মুঠোফোনের আগমন চিঠিকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে না পারলেও, আধুনিক স্মার্টফোন তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। তাই আজ স্মার্টফোন ও ইমোজির বদান্যতায় চিঠি লেখার পাঠ পুরোপুরি চুকে গিয়েছে। সেই সঙ্গে হারিয়েছে চিঠিতে ব্যবহৃত বিশেষ-বিশেষ শব্দও।

আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবাধীন এই যুগ বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন। প্রযুক্তি নামক সমুদ্রের বেলাভূমিতে আছড়ে পড়া একের পর এক ঢেউ বদলে দিয়েছে আমাদের বহু অভ্যেস। তাই তো নববর্ষে বা বিজয়া দশমীতে প্রিয়জনের চিঠির জন্য হাপিত্যেস করে আজ আর কেউ বসে থাকেন না। সব চেয়ে বড় কথা ‘করিতকর্মা’ মুঠোফোনের আলস্যে বাঙালিও আজ আত্মীয় বা অনাত্মীয়র কাছ থেকে কোন চিঠিই আশা করে না। আশা করবেই বা কী করে? স্মার্টফোনের দাক্ষিণ্যে আজ প্রিয়জনের কাছে চিঠি লেখার চল ‘বিলুপ্তপ্রায়’। ‘বিলুপ্তপ্রায়’ বলার কারণ, আজও এই বঙ্গের বিদ্যালয় শিক্ষায় বাংলা বিষয়ের পাঠ্যক্রমে চিঠি লেখার বিষয়টি টিমটিম করে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। যদিও তার বেশিরভাগই হয় প্রশাসনিক কোন চিঠি, নয়তো বা বন্ধুর কাছে লেখা। নয়তো রয়েছে বিবাহ, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ বা কিছু আনুষ্ঠানিক চিঠি লেখার প্রচলন। স্বভাবতই গুরুজনদের কাছে আর চিঠি লেখাই হয় না।

তাই বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই ‘শ্রীচরণেষু’ বা ‘শ্রীচরণকমলেষু’ শব্দগুলির সঙ্গে কোনও দিন পরিচয়ই ঘটেনি। যদিও এতে তাদের বিন্দুমাত্র কোন দোষ নেই। কারণ তারা যে যুগে জন্মেছে সেই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয় তারা গুরুজনদের নববর্ষ বা শুভ বিজয়ার প্রণাম জানাচ্ছে মুঠোফোনে, না হয় ভিডিয়ো কলে। নয়তো বা সমাজমাধ্যমে বহুল প্রচলিত নানা ইমোজির মধ্যে থেকে পাঠিয়ে দিচ্ছে ‘জোড়হাত’ এবং লাল রঙা ‘ভালোবাসার প্রতীক’ চিহ্ন। বর্তমানে এই ইমোজিই নিবিড় আবেগ প্রকাশের এক প্রধান ও দ্রুততম মাধ্যম। যে ভাণ্ডারে রয়েছে মনের সমস্ত রকম অনুভূতির জন্য আলাদা আলাদা চিহ্ন, যা ব্যবহার করা শুধুমাত্র এক আঙুলের খেল। সে অনুভূতি হাসির হোক বা কান্নার, রাগের হোক বা দুঃখের— সবই রয়েছে সেই ভাণ্ডারে। নতুন প্রজন্ম এ ভাবেই অভ্যস্ত। অন্তর্জালে আবদ্ধ হয়ে এ ভাবেই তারা পলকে প্রিয়জনকে শ্রদ্ধা বা ভালবাসা জানাতে বেছে নিয়েছে ‘শর্টকাট’। তা হলে কেনই বা তারা অকারণে সময় নষ্ট করে সাদা কাগজে কলমের দাগ কাটতে যাবে? তাই তো প্রতি বছর ‘নববর্ষ’ বা ‘বিজয়া’ শুভেচ্ছা ফোনে মিললেও, চিঠি আর আসে না।

(সহকারী শিক্ষক, গোপালনগর এম এস এস হাই স্কুল (উঃ মাঃ), দিনহাটা)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Letter Writing North Bengal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy