অসহায়: তখনও আটকে। মঙ্গলবার রাতে। নিজস্ব চিত্র
রাত তখন ৯টা। কনকনে ঠান্ডা। কোচবিহার শহর ঘুমোতে যাওয়ার তোড়জোর করছে। কামেশ্বরী রোড ধরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিলেন আরমান আহমেদ। হঠাৎ কানে গেল কুকুরের আর্তনাদ।
চমকে উঠে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখেন, কোনও কুকুর নেই। তারপরে চোখ যান পাশেই ব্যাঙ্কের বাড়িটায়। খেয়াল করে দেখেন, ব্যাঙ্কের দরজার পাশের এক ফালি বেরোনোর গলির মুখে আটকে পড়েছে একটি পথকুকুর। সামনের গ্রিলের দরজায় তালা। কখনও গেট কামড়ে বের হওয়ার চেষ্টায় ছুটোছুটি করতে মরিয়া চেষ্টা করছে। অনেক চেষ্টাতেও সফল না হওয়ায় শেষে কুকুরটি রাত হতেই আর্তনাদ শুরু করে দেয়।
আরমানকে এগিয়ে যেতে দেখে আশপাশের আরও কয়েকজন এগিয়ে যান। যাঁরা ওই পাড়াতেই থাকেন, তাঁরা কুকুরটিকে চিনতেও পারেন। তাকে ‘কালু’ বলে ডাকে সকলে। তালা খুলে দেওয়ার জন্য, নানা ভাবে চেষ্টা করে ব্যাঙ্কে কাজ করেন এমন দু’এক জনের ফোন নম্বরও জোগাড় করা হল। আরমান বলেন, ‘‘কিন্তু সকালের আগে তালা খোলা যাবে না বুঝতে পেরে গেলাম।’’ তিন তলা বাড়িটিতে ব্যাঙ্কের শাখা থাকায়, তালা খোলার ঝুঁকি কেউ নিতেও চাননি।
শীতের রাত তখন আরও গড়িয়েছে। দোকানপাট বন্ধ হওয়ার আগেই কেউ কেউ কিনে নিয়ে এসেছেন বিক্সুট। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সেই বিস্কুট ছুড়ে দেওয়া হল কালুর দিকে। নানা ভাবে চেষ্টা করেও জলের বোতল ভিতরে ফেলতে না পেরে এক জনের বুদ্ধিতে কোনওমতে বোতলটির মুখটুকু ভিতরে ঢুকিয়ে জল ঢেলে দেওয়া হল চাতালে। কালু চেটেপুটে সাফ করে দিল সঙ্গে সঙ্গে।
এ বার কালুর কান্না একটু কমেছে। আরমান বলেন, ‘‘কুকুরটা বোধহয় বুঝতে পারছিল, আমরা ওকে সাহায্যই করতে চেয়েছি।’’ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক রাজা বৈদ বলেন, রাতে বাড়ি ফেরার সময় ঘটনাটি তাঁরও নজরে পড়ে। কুকুরটিকে উদ্ধারের ব্যাপারে সব রকম চেষ্টা করা হয়। তবে উপস্থিত বাসিন্দারা কুকুরটির খাবারের ব্যবস্থা করেছিল। অশোক মুরগান নামে এক বাসিন্দা দারুণ সাহায্য করেন। তাতেই রাত দু’টো বেজে যায়।
বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, শনিবার থেকে ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। সেদিন থেকেই কুকুরটি অসর্তকতায় আটকে পড়েছিল বলে তাঁদের অনুমান। কারণ ওই দিন সন্ধের পর থেকে আর গেট খোলেনি। অন্য কোনও জায়গা দিয়েও কুকুরের ঢোকা বা বেরনোর অবস্থা ছিল না। তাতেই খিদে, তেষ্টা আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ে কালু। অবশেষে বুধবার সকালে বেরোয় কালু।
ওই ব্যাঙ্কের এক আধিকারিকের অবশ্য দাবি, ‘‘ওই ভবনে একাধিক অফিস আছে। শনিবার আমাদের কেউ বন্ধ করেনি। আমরা যখন বেরোই কুকুরটিকে দেখা যায়নি। কাল বেশি রাতে ওই বিষয়টি জানতে পেরেছিলাম।’’
কিন্তু রাতে শহরের রাস্তায় পুলিশের টহলদারি জিপের তো যাওয়ার কথা। শহরের মানুষের প্রশ্ন, তারা কোথায় ছিল? কোচবিহার থানার পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘টহলদারি জিপ ছিল ঠিকই। কিন্তু এমন কোনও ঘটনা চোখে পড়েনি।’’ শহরের এক প্রবীণ নাগরিকের অবশ্য সব শুনে মন্তব্য, ‘‘এখনও কোচবিহার শহর যে একটি পথ কুকুরের জন্য শীতের মাঝ রাত পর্যন্ত জাগে, তা শুনে গর্বিত বোধ করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy