হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির দুর্গাপুজো জাতীয় উৎসব, ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমাও পেয়েছে। পুজো উপলক্ষে পত্রিকা আর নতুন বইয়ের সমাবেশও ছিল। তবে এ বারের দুর্গাপুজো বাঙালির মননে, ২৬ -এর বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে আটকে রইল।
বাঙালির দুর্গোৎসবের বহুমাত্রিকতায় রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মতাদর্শের ভিত্তিতে রচিত নানা বই, পত্রপত্রিকা দিয়ে সাজিয়ে স্টল করেন। উত্তরবঙ্গের জেলা শহরগুলিতে এ বারে তৃণমূল দলের জাগো বাংলার ষ্টল ও বিজেপি দলের রাষ্ট্রবাদী মঞ্চের নিজস্ব পুঁথি পত্রের সম্ভার, মার্কসীয় সাহিত্য নিয়ে এসইউসিআই ও সিপিএম, আরএসপি দলের স্টলগুলি সকলেই একসঙ্গে সহাবস্থান করেছে। দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী অতি-বামপন্থী, সনাতনী, রাষ্ট্রবাদী, দলের পাশাপাশি অভয়া মঞ্চ ও বিভিন্ন শহরের নাগরিক দলের প্রতিবাদী নাগরিক মঞ্চগুলিও সমান উদ্যমে মঞ্চ বেঁধে নিজস্ব প্রতিবাদের প্রচার পুস্তিকা বিতরণ করেছেন। কোনও কোনও মঞ্চে কবিতা পাঠ, বক্তৃতা, গান-বাজনাও হয়েছে। সবাই দেশের কোন না কোনও সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। সকলের প্রতিবাদের ধরন পছন্দ না হতে পারে কিন্তু প্রতিবাদের কারণটিকে হয়তো অস্বীকার করা যায় না। উৎসবের পাশেই আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদী কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করা গেল।
পুজোর মুখে ক্লাবগুলিকে অনুদান, পরিযায়ী শ্রমিক, শ্রমশ্রী ভাতা প্রকল্প, সরকারি কর্মচারীদের ডিএ মামলা, চাকরিহারা মাস্টারমশাইদের পুনরায় এসএসসিতে বসা, এ সবের সঙ্গে ঝড়-বৃষ্টি, নদী ভাঙন, বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া, অতিবৃষ্টি পাহাড়ে ধস, প্রকৃতি, পরিবেশে, সমাজ জীবনে ভয়ঙ্কর সব দুর্যোগের পরেও বাঙালি প্যান্ডেল হপিং করেছে, হোটেল-রেস্তরাঁয় দেদার খেয়েছে ,কার্নিভাল, বিজয়া সম্মিলনী শেষ করে দীপাবলিতে মেতেছেন এবং ছটপুজো এবং ভোটারপঞ্জি সংস্কারে কী করণীয় তাও ঠিক করে ফেলেছেন। দুর্ভাগ্য, এত সবের মধ্যেও উত্তরবঙ্গের একটা বড় অংশের মানুষ এই আনন্দ উৎসবের বাইরেই রয়ে গেলেন।
পুজোর মুখেই ডুয়ার্স ও তরাই মিলিয়ে অন্তত চল্লিশটি চা বাগান ঘিরে সঙ্কট তৈরি হয়। সরকার ঘোষিত ২০ শতাংশ হারে শ্রমিকদের বোনাস দেয়া সম্ভব নয় বলে চা বাগানগুলির মালিক তথা পরিচালকেরা বিভিন্ন সংগঠনকে জানিয়ে দিলেন। চা বাগান পরিচালকদের সংগঠন সূত্রের দাবি শুধু ৪০টি নয়, শতাধিক চা বাগানে বোনাসের সঙ্কট রয়েছে। বন্ধ চা বাগানগুলি যে অন্ধকারে ছিল, সেখানেই রয়েছে। মালদহে নদী ভাঙনে, ডুয়ার্সে বন্যায়, পাহাড়ের ধসে ঘর হারিয়ে কত মানুষ যে উৎসবে অংশগ্রহণ করতেই পারলেন না, এ সবের জন্য কোনও প্রতিবাদী মঞ্চে আওয়াজ উঠতে তেমন দেখলাম না।
বাঙালি ভাবে-চেতনায়-মননে বিপ্লবী। শাসক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অতীতেও ছিল আজও আছে। সকলেই অন্যায়, অপরাধের অবসান চায়, বিচার চায়! উৎসবের আবহে এমন প্রতিবাদ দেখে মনে হল, অঙ্ক কষে চলাই বোধহয় এখন প্রতিবাদের নিয়ম। আগামী নির্বাচনে জেতার কৌশল কী হবে, তা বোঝার ক্ষেত্র হয়ে উঠল উৎসব প্রাঙ্গণ। এ বারের উৎসব পর্বে বাঙালিদের বড় অংশ ভক্ত নয়, ভোটার হয়ে রইলেন।
প্রাবন্ধিক এবং প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)