কথায় বলে, বারবার তিনবার। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজ সেই মাত্রাও ছাড়িয়ে গেল। শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের হামলায় দায়িত্ব ছাড়তে চাইলেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তিন বছরে এই নিয়ে চারজন ওই পদ থেকে ইস্তফা দিতে চাইলেন। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ উত্তম রায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রাণহানির আশঙ্কা করে অব্যহতি চাইছেন তিনি।
উত্তমবাবু বৃহস্পতিবার বলেন, “আমার উপর টিএমসিপি (তৃণমূল ছাত্র পরিষদ) হামলা চালাতে পারে। প্রাণহানির আশঙ্কাও রয়েছে। ঠিক করেছি, যতদিন না নিরাপদ বোধ করছি, শুক্রবার থেকে ততদিন কলেজে যাব না।” তিনি জানিয়েছেন, ছুটির আবেদন করা, বা আর কারওকে দায়িত্ব হস্তান্তর করার জন্যও অপেক্ষা করবেন না তিনি। পুলিশে বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও জানাবেন না। তাঁর দাবি, ঘটনার গুরুত্ব বোঝাতেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তবেই তিনি জানাবেন।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোমনাথ ঘোষ অবশ্য জানিয়েছেন, “উত্তমবাবু ছুটি না নিয়ে, কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে নিজের দায়িত্ব থেকে সরতে পারেন না। তাঁর অনুপস্থিতির জন্য কলেজে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা বা অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে।” যা শোনার পরে উত্তমবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমি প্রায় দু’মাস আগে পদ থেকে ইস্তফা চেয়ে উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু আমার ইস্তফাপত্র গৃহীত হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে কলেজে গিয়ে আমি প্রাণ দিতে তো দিতে পারি না। আমার পরিবার রয়েছে।”
রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিলীপ দে সরকারকে কলেজে ঢুকে বেধড়ক মারধর করেছিল টিএমসিপি। টিভিতে সে দৃশ্য দেখেছিল রাজ্যবাসী। প্রবল সমালোচনার মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, “ছোট ছেলেরা একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে।” এর পর থেকেই রায়গঞ্জ কলেজে অধ্যক্ষ-নিগ্রহের অভিযোগ বারবার উঠেছে। অভিযোগের তিরও শাসকদলের দিকেই। তিন বছরে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের তিন জন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বদল হয়েছেন।
২০১২-র ৫ জানুয়ারি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিলীপ দে সরকারকে কলেজে ঢুকে নিগ্রহ ও লাঠিপেটা করার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা কার্যকরী সভাপতি তিলক চৌধুরী, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তৎকালীন জেলা পর্যবেক্ষক প্রিয়ব্রত দুবে-সহ অনেকের বিরুদ্ধে। বর্তমানে অভিযুক্তরা আদালতের নির্দেশে জামিনে রয়েছেন। ওই ঘটনার পর দিলীপবাবু পদ থেকে ইস্তফা দেন। তারপরে শত্রুঘ্ন সিংহ নামে কলেজের আরেক শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। প্রায় পাঁচ মাস দায়িত্ব সামলানোর পরে নানা সমস্যার জেরে তিনিও সরতে বাধ্য হন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এরপর দেবাশিস বিশ্বাস ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। দেবাশিসবাবু তৃণমূলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলায় রোষের মুখে পড়েন। তাঁকেও সরতে হয়। ’১৩-র ৮ মার্চ উত্তমবাবু দায়িত্ব নেন।
কেন উত্তমবাবুকে সরতে হচ্ছে? ওই কলেজের ছাত্র সংসদ ছাত্র পরিষদের। সম্প্রতি টিএমসিপি সমর্থক এক ছাত্রী অভিযোগ করেন, শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান চলাকালীন তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে ছাত্র পরিষদের তিন সদস্য। তাঁরা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মারধর, শ্লীলতাহানির মামলা করে। কিন্তু উত্তমবাবু দাবি করেন, ওই অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। টিএমসিপি তদন্তের দাবি জানালে অধ্যক্ষ রাজি হননি। ক্ষুব্ধ টিএমসিপি তাঁর বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও রাজনীতি করার অভিযোগ আনে। তাঁর অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে গত সোমবার।
জেলা তৃণমূল সভাপতি অমল আচার্য উত্তমবাবুকেই দুষেছেন। তাঁর অভিযোগ, “ছাত্র পরিষদ ভয় দেখিয়ে, মারধর করে ছাত্র সংসদ নিজেদের দখলে রেখেছে। এখন পড়ুয়ারা টিএমসিপিকে সমর্থন করছে। সেটা বুঝতে পেরে কংগ্রেস ও ছাত্র পরিষদ নানাভাবে টিএমসিপি-র নামে বদনাম রটাচ্ছে। উত্তমবাবু কলেজের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে নিজের ভূমিকা পালন করছেন না।”
জেলা কংগ্রেস সভাপতি মোহিত সেনগুপ্তের অভিযোগ, “টিএমসিপি গত আড়াই বছর ধরে কলেজের শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করছে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে।”