Advertisement
২১ মে ২০২৪
Story of Rita Chowdhury

শূন্য থেকে শুরু করা রীতার হাতে আজ ‘লক্ষ্মীর ঝাঁপি’

রোজকার রুটিন বাঁধাধরা। সকালে উঠে সেলাই, তার পরে নানা কাজের প্রশিক্ষণ দিতে যাওয়া, দুপুরে গোষ্ঠীর কাজ, বিকেল থেকে দোকান সামলানো।

লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনে ব্যস্ত রীতা চৌধুরী। আঁকছেন আলপনা, লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। ছবি: সন্দীপ পাল

লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনে ব্যস্ত রীতা চৌধুরী। আঁকছেন আলপনা, লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। ছবি: সন্দীপ পাল sandipabp4@gmail.com

নিজস্ব সংবাদদাতা
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৪৮
Share: Save:

সে বার মাধ্যমিক পরীক্ষা। একই বছরে মা-বাবার মৃত্যু হল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে, পরিবারের অন্যেরা বিয়ে দিয়ে দিলেন। মেয়ের মা হলেন তিনি। সবে মেয়ে বড় হচ্ছে, স্বামীর চাকরিতে উন্নতি হয়ে ‘হেডকোয়ার্টারে’ কাজ করতে হচ্ছে। এক দিন সেই অফিস থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনা। স্বামী যে শিলিগুড়ি থেকে বাড়ি ফেরার জন্য জলপাইগুড়িতে রওনা হয়েছেন সেটুকুও জানতেন না রীতা চৌধুরী। আট বছর আগে, রীতার বয়স তখন ৩৭। মেয়ের সবে ৯ পেরিয়েছে। শুরু করলেন হাতের কাজ শেখা। আট বছর পরে, এখন তিনি প্রশিক্ষক, একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দলনেত্রী, মেয়েদের সাজা, ঘর সাজানোর দোকানের মালিক। শুধু তা-ই নয়, পরিবারের পাঁচ সদস্যের ভরসাও তিনি, এক মাত্র উপার্জনকারী। সেই তিনি, শনিবার সকালে উঠে পুজোর সরঞ্জাম জোগাড় করে, স্নান সেরে হাতে তুলি নিয়ে উঠোন থেকে ঘরের দিকে যাওয়ার লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকলেন। লক্ষ্মীপুজোর ভোগের আনাজ কুটতে কুটতে শাশুড়ি কৃষ্ণা চৌধুরী বললেন, ‘‘বৌমা সব কাজই পারে। সকাল থেকে নাগাড়ে কাজ করে যায়। শরীরে ক্লান্তি থাকলেও সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথাও বলতে পারে। শুনেছি কেউ কেউ লক্ষ্মীমন্ত হয়,আমার বৌমারও অনেক গুণ।’’

রোজকার রুটিন বাঁধাধরা। সকালে উঠে সেলাই, তার পরে নানা কাজের প্রশিক্ষণ দিতে যাওয়া, দুপুরে গোষ্ঠীর কাজ, বিকেল থেকে দোকান সামলানো। বাড়ি ফিরে রাত জেগে ঘর সাজানোর জিনিস, গয়না তৈরি করা। লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনের সঙ্গে সেলাই, হাতের কাজ বাদ যায়নি কিছুই। রীতা বললেন, ‘‘পুজোর সময় বিক্রি বেশি হয়। তাই দোকানে বেশি থাকতে হয়। বাড়ির পুজোর কাজ সামলেও সময় দিতে হয়। মেয়েটাকে আইন কলেজে ভর্তি করিয়েছি, শ্বশুরের চিকিৎসাও চলছে। স্বামী যে দিন চলে গেলেন, তখন ভেবেছিলাম, সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই।’’

জলপাইগুড়ি পুরসভার সহযোগিতায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে কাজ শুরু করেছিলেন রীতা। পুরসভার সিটি ম্যানেজার ভাস্কর সরকার বলেন, ‘‘আমারও সেই দিনটির কথা মনে আছে। কাঁদতে কাঁদতে রীতা চৌধুরী অফিসে এসে স্বামীর মৃত্যুর খবর জানিয়েছিলেন। তার কিছু দিন আগেই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ওঁকে আমরা বলেছিলাম, মন দিয়ে ঘর সাজানোর কাজ করে যেতে। এখন উনি প্রশিক্ষক। পরিবারের সকলের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনিই।’’

শনিবার দুপুর ১টার সময় জলপাইগুড়ির রাজবাড়িপাড়ায় রীতার বাড়িতে পুরোহিত এসেছিলেন পুজোয়। ধূপ, ধূনোর গন্ধ, ঘণ্টা, উলুধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল এ ঘর থেকে ও ঘরে। একটা সময় শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন রীতা। ধূপের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে। ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে বসার আগে বলছিলেন, ‘‘সে দিন মানুষটা যে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিয়েছিল, তা-ও জানতাম না। কোনও কথাও হয়নি সে দিন।’’

আট বছর পেরিয়ে গিয়েছে। পুজো শেষ হতেই উঠে পড়লেন রীতা চৌধুরী। সবাইকে প্রসাদ দিয়ে বেরোতে হবে। সারা দিনের বাকি কাজের ঝাঁপি নিয়ে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jalpaiguri Self reliance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE