Advertisement
E-Paper

নদী ভেঙেছে পরিবার, ভালবাসাও

খড়ের ভাঙা বেড়া দেওয়া সেই ঘরের সামনে বসে নোকেশ বলেন, “সাত-সাতবার জমিজমা, ভিটেমাটি  গিলেছে গঙ্গা। সব হারিয়েছি আমরা। কিন্তু তার পরও বেঁচে আছি। তবে শোক সহ্য করতে না পেরে বাবা চলে গেলেন ’৯৯ সালে।’’

জয়ন্ত সেন 

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৯ ০১:২০
 ডুবাইলি রে: ভাঙনের নদী। মালদহের বাঙ্গিটোলায়। ছবি: তথাগত সেন শর্মা

ডুবাইলি রে: ভাঙনের নদী। মালদহের বাঙ্গিটোলায়। ছবি: তথাগত সেন শর্মা

গঙ্গার পাড়ে কামালুদ্দিনপুরের গ্রামে তখন তাঁদের প্রায় ৩৫ বিঘা জমি। ধান তো বটেই, হরেক কিসিমের আনাজ চাষ হত সেখানে। পাশাপাশি আমের বাগান, কলা বাগান ও বাঁশের বিশাল ঝাড়ও ছিল। ইটের গাঁথনি দেওয়া বাড়িরই একপাশে পালিত হত গোরু, ছাগল থেকে শুরু করে হাঁস-মুরগিও। বছরভরই বাড়িতে থাকত গোলাভরা ধান। কৃষির আয়েই চলত ভরা সংসার।

তবে বাবা কৃষিকাজ করলেও তাতে খুব একটা মন ছিল না তখন সদ্য তরুণ নোকেশ মণ্ডলের। তাঁর চোখে তখন স্বপ্ন, লেখাপড়া করে শিক্ষকতা করবেন। ১৯৯২ সালে মাধ্যমিক পাশ করে পাঁচকড়িটোলা হাইস্কুলে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিও হন। তখনও জানেন না, গঙ্গার পাশে তাঁদের যে জমি-বাড়ি রয়েছে তা এক লহমায় গ্রাস করে নেবে নদী! হলও তাই। সে বছরই অগস্টে উত্তাল গঙ্গা গিলে নিল ভিটে, জমির একাংশ। নোকেশের স্কুলবাড়িও গেল গঙ্গায়। বাকি জমির একদিকে নতুন করে মাথা গোঁজার আস্তানা হল তাঁদের। সরকার বাহাদুর বাঁধও করল। কিন্তু সেই বাঁধ রক্ষা করতে পারল না কিছুই। ১৯৯৮ সালের মধ্যে বারবার ভাঙনে গঙ্গায় সব দিয়ে ভিটেমাটি হারালেন নোকেশরা। ২৩ সংসদ বিশিষ্ট কেবিঝাউবোনা গ্রাম পঞ্চায়েতটাই মুছে গেল মালদহের মানচিত্র থেকে।

স্কুলটি একই নামে বাঙ্গিটোলা এলাকায় স্থানান্তরিত হলেও লেখাপড়ার গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটল নোকেশের। উল্টে পরিবারের সকলের দুবেলা পেটে ভরবে কী করে, সেই দায়িত্ব তখন পরিবারের একমাত্র ছেলে নোকেশের কাঁধে। শুরু হল অন্যের জমিতে দিনমজুরি। বছর পাঁচেকের মধ্যে চর পড়ে নদীমাঝে তাঁদের জমি ফের গজিয়ে উঠল ঠিকই, কিন্তু তাতে বালির পরিমাণ এতটাই বেশি যে আগের মতো চাষাবাদের জো নেই। তবু জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে সেই চরের জমিতেই নোকেশ ফলাচ্ছেন ধান, নানা আনাজ।

সেই ’৯৮ থেকে বাঁধের গা ঘেঁষে কুঁড়ে ঘরে ঠাঁই নোকেশদের। খড়ের ভাঙা বেড়া দেওয়া সেই ঘরের সামনে বসে নোকেশ বলেন, “সাত-সাতবার জমিজমা, ভিটেমাটি গিলেছে গঙ্গা। সব হারিয়েছি আমরা। কিন্তু তার পরও বেঁচে আছি। তবে শোক সহ্য করতে না পেরে বাবা চলে গেলেন ’৯৯ সালে।’’ নোকেশের দুচোখ জলে ভিজে যায়।

তার পরেও গঙ্গা আপন খেয়ালেই বইছে। স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাঁধের পাড়ে সরকারি জায়গাতেই চলছে নোকেশের সংগ্রাম। বর্ষায় নদী যখন ফুলেফেঁপে ওঠে, তাঁদের ঠাঁই হয় বাঁধের উপর, ত্রিপলের তলায়।

গঙ্গার হানাদারিতে এমন ‘ট্র্যাজেডির’ কাহিনি কালিয়াচক-২ ব্লকের বাঙ্গিটোলার সঙ্গে রতুয়ার বিলাইমারি থেকে শুরু করে মানিকচক, কালিয়াচক-৩ ব্লকের শেষ সীমান্ত শোভাপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। কেউ বাঁধের পাড়ে, কেউ অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ পরিবার নিয়ে চলে গিয়েছেন ভিন রাজ্যে। গঙ্গাভাঙন নিয়ে আন্দোলনকারী তরিকুল ইসলাম (নিজেও ভিটেমাটি হারিয়েছেন) বলছিলেন, ‘‘গত ৪০ বছরে জেলার গঙ্গা পাড়ের অন্তত ২ লক্ষ মানুষ গঙ্গার কড়াল গ্রাসে ভিটেমাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই দু’মুঠো অন্ন যোগাতে পাড়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে। কৃষিকাজ পেশা ছেড়ে হয়েছেন নির্মাণ শ্রমিক। মাছ ধরা ছেড়ে হয়েছেন রাজমিস্ত্রির জোগানদার। মোদ্দা কথা, ছিলেন জমিদার, হয়েছেন ভিখিরি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘গঙ্গা শুধু জমিজমা, ঘরবাড়ি ভাঙেনি ভেঙেছে পরিবার, আত্মীয়, ভালবাসাও।’’ ভাঙনে কার্যত উদ্বাস্তু হওয়া নোকেশ মণ্ডল, দানেশ শেখ, জুবেদা বেওয়ারা বলেন, “জেগে ওঠা চরে আর ডাকে না কোকিল, চড়ুই, বাবুই, ঘুঘু। শেয়াল, শকুনও দেখা যায় না।’’ সেই শ্রীহীন চরাচরে লেখা শুধুই ভাঙনের ইতিকথা।

River Bank Erosion Malda
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy