Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Education

‘বিদ্যুৎ সংযোগ না আসুক, ছেলেমেয়ের পড়া থামাব না’

সন্ধের পরে পাশের পেট্রল পাম্পের আলোর নীচে মেঝেয় ধুলো-ধোঁয়ার মধ্যেই ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসান সেই মা, সবিতা তন্ত্র।

গ্যাস নেই। ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্যে কাঠের উনুনে তড়িঘড়ি রান্না সারছেন সবিতা। 

গ্যাস নেই। ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্যে কাঠের উনুনে তড়িঘড়ি রান্না সারছেন সবিতা।  ছবি: সন্দীপ পাল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৩ ০৯:১৬
Share: Save:

এ এক স্কুলছুট মেয়ের অভিমানের কাহিনি, এ এক মায়ের লড়াইয়েরও কাহিনি।

স্কুলপড়ুয়া মেয়েটির তেমন কোনও স্বপ্ন ছিল না, শুধু আরও পড়তে চেয়েছিল। সেটুকুও হয়নি। নবম শ্রেণিতে উঠতেই বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। অথচ, পরের বোন মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে, ছোট বোন উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। বাড়িতে মা অসুস্থ, তাই ‘বড় দিদি’ হওয়ার সুবাদেই সে-ই রান্না করে ভাই-বোনেদের স্কুলে পাঠাত, নিজেও যেত। অথচ, তাকেই পড়া ছাড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। সে অভিমান বুকে নিয়েই মেয়েটি সংসার পা দিল। পুত্র সন্তান, দুই যমজ কন্যাকে নিয়ে শুরু হল মায়ের লড়াই। স্কুলছুট সেই অভিমানী মেয়েটি মা হয়ে ঠিক করলেন, যে ভাবেই হোক সন্তানেরা অন্তত তাঁর থেকে বেশি পড়াশোনা করবে। তার পরের ‘কাহিনি’ রোজ দেখেন জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া পাহাড়পুরের বালাপাড়ার বাসিন্দারা। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সন্ধের পরে পাশের পেট্রল পাম্পের আলোর নীচে মেঝেয় ধুলো-ধোঁয়ার মধ্যেই ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসান সেই মা, সবিতা তন্ত্র।

মঙ্গলবার বালাপাড়ার বাড়ির উঠোনে বসে সবিতা বলেন, “আমার চার বছরের দুই মেয়ে তো জন্ম থেকেই বাড়িতে আলো দেখেনি। এগারো বছরের ছেলে যখন জন্মেছিল, তখন অবশ্য বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল।” সবিতার বাবা ছিলেন রেলের কর্মী। এ দিন দুপুরের রোদে ঘুপচি ঘরে বসে সবিতা বললেন, ‘‘সারা দিন গরমে কাজ করতে কষ্ট হয়। বিকেলের পরে, শরীর আর চলে না। কিন্তু আমি না পড়ালে, ছেলেমেয়েদের পড়া হবে না, ভাবলেই জেদ চাপে।”

গলায় ফেলে রাখা গামছাটির একপ্রান্ত মুখে চেপে ধরে বললেন, “আমি চাই, আমার থেকে যেন একটু হলেও ছেলেমেয়েরা বেশি পড়াশোনা করে।” সবিতা জানান, ছোট থেকেই তাঁর মা অসুস্থ ছিলেন। তিনিই বাড়ির সব কাজ করতেন। যেই নবম শ্রেণিতে ওঠেন, পড়া ছাড়িয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। এক বারও তাঁর ইচ্ছে জানতে চায়নি সেদিন কেউ। একটু থেমে বললেন, “ছেলেমেয়ের পড়া তবু থামতে দেব না। বাড়িতে বিদ্যুৎ আর আসুক বা না আসুক।”

বিদ্যুৎ দফতর জানিয়েছে, বকেয়া এক লক্ষ ৪৬ হাজার টাকার বিল শোধ না করলে বালাপাড়ার তন্ত্র পরিবারের সংযোগ দেওয়া যাবে না। বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগে ২০১৫ সালে বাড়ির সংযোগ কেটে দিয়েছিল দফতর। সেই থেকে অন্ধকার বালাপাড়ার চার লেনের সড়কের পাশের এই বাড়িতে। সবিতার স্বামী আপন তন্ত্র বললেন, “আমাদের মিটার থেকে পাঁচটা বাল্ব জ্বলত আর মিটার থেকে তার টেনে নিয়ে গিয়ে সামনের দোকানের একটি বাল্ব জ্বলত। এটাকে চুরি বলে?”

আপনের প্রশ্ন, “প্রচুর বিল দেখে ভয়ে বাবা আত্মহত্যা করল। প্রায় আট বছর ধরে বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ নেই। উঠোনের উপর দিয়েই বিদ্যুতের তার গিয়েছে, ইচ্ছে করলে তো হুক করে সংযোগ নিতাম, কেউ টের পেত না। কিন্তু তা করিনি। চুরির অভিযোগ ফিরিয়ে দফতর আবার সংযোগ দিলে তবেই সংযোগ নেব।”

স্বামীর জেদের কথায় সম্মতি দেন সবিতা। তাঁরও মনে জ্বলছে আর এক জেদ। দরমা-বেড়ার বাড়ির অন্ধকারে সেটাও ‘আলো’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jalpaiguri Petrol Pump
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE