Advertisement
E-Paper

দুর্ঘটনা, রোগকে হারাল মনের জোর

ওদের দুজনের একজন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। অন্যজন দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। ওরা দুজনেই সহপাঠী। একই স্কুল থেকে একই সঙ্গে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ওরা। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে কেবল মনের জোরে ওদের দুজনের একজন শুভাঙ্গনা সাহা মাধ্যমিকে পেয়েছে ৬১১ নম্বর। আর সঙ্গীতা হাজরা পেয়েছে ৫১৭ নম্বর।

রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০২:৪০
(বাঁ দিক থেকে) শুভাঙ্গনা ও সঙ্গীতা। —নিজস্ব চিত্র।

(বাঁ দিক থেকে) শুভাঙ্গনা ও সঙ্গীতা। —নিজস্ব চিত্র।

ওদের দুজনের একজন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। অন্যজন দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। ওরা দুজনেই সহপাঠী। একই স্কুল থেকে একই সঙ্গে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ওরা। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে কেবল মনের জোরে ওদের দুজনের একজন শুভাঙ্গনা সাহা মাধ্যমিকে পেয়েছে ৬১১ নম্বর। আর সঙ্গীতা হাজরা পেয়েছে ৫১৭ নম্বর। দুজনেই জলপাইগুড়ির সুনীতিবালা সদর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী।

শুভাঙ্গনার পরিবার সুত্রে জানা যায় যে সে দূরারোগ্য হাইপোথেলামিয়া গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শুভাঙ্গনাকে হঠাৎ ঘুম রোগ পেয়ে বসে। একই সঙ্গে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণাও হত। পারিবারিক সুত্রে জানা গিয়েছে একটানা এক সপ্তাহ ধরে ঘুমোত সে। এই সময় খাদ্য তরল করে ঘুমের মধ্যেই কোনওরকমে খাওয়ানো হতো তাকে। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ থাকত। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কলকাতায় চিকিৎসা করিয়েও রোগ ধরা পড়েনি। ২০১৪ সালের মার্চ তাকে বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেন্টাল হেলথ এবং নিউরো সায়েন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে ধরা পড়ে মস্তিস্কের যে অংশটি আমাদের ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে একটি টিউমার হয়ে আছে।

সেখানে তার একটি জটিল অস্ত্রোপচার করে টিউমারটি বার করে আনা হয়। গত বছর মার্চ মাসের ২১ তারিখে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার পর তার ঘুমের সময় কমেছে। কিন্তু ঘুম রোগ তাকে ছেড়ে যায়নি। এখনও একবার ঘুমিয়ে পড়লে ঘুম ভাঙাতে সমস্যা হয়। টেস্ট পরীক্ষার একমাস আগে থেকে সে একটু একটু করে পড়াশোনা শুরু করে। স্কুল সুত্রে জানা যায় যে শুভাঙ্গনা পড়াশোনায় বরাবর ভাল ছিল। সে অসুস্থ হওয়ার পর তাই স্কুলের শিক্ষিকারা তাকে যথাসাধ্য সহায়তা করতে থাকেন।

মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলায় ৯৪, ইংরেজিতে ৮১, অংকে ৯৯, ভৌত বিজ্ঞানে ৯৩, জীব বিজ্ঞানে ৯০, ইতিহাসে ৭৪ এবং ভূগোলে ৮০ নম্বর পেয়েছে শুভাঙ্গনা। মোট ৬১১ নম্বর সে পেয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের লেখা পড়তে ভালবাসে শুভাঙ্গনা। গৌতম গম্ভীর এবং শাহরূখ খানেরও ভক্ত সে। শুভাঙ্গনার প্রিয় বিষয় অঙ্ক। কিন্তু রোগের কারণে অঙ্ক নিয়ে পড়তে পারবে না। শুভাঙ্গনা বলে, “আমি চাপ নিতে পারছি না। তাই ঠিক করেছি আর্টস নিয়ে পড়বো। ভবিষ্যতে আমার বিচারক হওয়ার ইচ্ছে আছে।” তার মা সুদেষ্ণা দেবী বলেন, “পড়াশোনা করার অদম্য ইচ্ছে আর মনের জোরই ওকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।” তার বাবা দেবাশিসৃ সাহা জলপাইগুড়ি ট্রাফিক পুলিশ বিভাগে কর্মরত।

২০১৪ সালের মার্চ মাসে শুভাঙ্গনা যখন বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে শুয়ে, সেইসময় ২০ মার্চ তার বন্ধু সঙ্গীতা তাদের ইন্দিরা কলোনির বাড়ি থেকে রিকশায় একজন শিক্ষিকার বাড়িতে পড়তে যাচ্ছিল। আচমকা একটি সরকারি বাস এসে তার রিক্সাকে ধাক্কা মারে। সঙ্গীতা পড়ে গিয়ে চাকার আঘাতে গুরুতর জখম হয়। তার মাথার একপাশ থেতলে যায়। ডানচোখ ঠিকরে বার হয়ে আসে। বুকের পাঁজরার হাড় ভেঙে যায়। তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে পরে শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার অস্ত্রোপচার হয়।

এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয় সঙ্গীতা। তার বুকে ক্ষত আছে। ডান চোখ সব সময় প্রায় বন্ধ থাকে। স্কুলে যেতে পারেনি। এই অবস্থায় পড়াশোনা করে সে ৫১৭ নম্বর পেয়েছে। বাংলায় ৮০, ইংরেজিতে ৬৭, অংকে ৯৭, ভৌতবিজ্ঞানে ৮০ জীববিজ্ঞানে ৮০, ইতিহাসে ৬০ এবং ভূগোলে ৫৩ নম্বর পেয়েছে। সঙ্গীতার প্রিয় খেলা ক্রিকেট। প্রিয় ক্রিকেটার শিখর ধবন। হাতের কাছে রাখা একটি খাতায় প্রিয় ক্রিকেটারদের নানা মূহুর্তের ছবি কেটে আটকে রাখে সে। এটাই নেশা তার। একটা অদ্ভুত হবি আছে। তার একটি খাতা আছে। সেই খাতায় সে খবরের কাগজ থেকে সমস্ত ক্রিকেটারদের ছবির নানা মূহুর্ত কেটে আটকে রাখে এবং পাশে ইংরেজিতে ক্যাপশন লিখে রাখে। ভবিষ্যতে শিক্ষিকা হওয়ার ইচ্ছে সঙ্গীতার।

ইন্দিরা কলোনির মোড়ে তাদের একটি রুটি এবং সবজির দোকান আছে তাদের। সঙ্গীতার বাবা জীবনবাবু এবং মা সুষমা দেবী দুজন মিলে দোকান চালান। চিকিৎসা করাতে গিয়ে তার পরিবার এখন নিঃস্ব। সুষমা দেবী বলেন, “মেয়েটাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে গেলে চেন্নাইয়ে নিয়ে গিয়ে অস্ত্রোপচার করা দরকার। প্রচুর টাকা দরকার। সেই টাকা আমরা কোথায় পাব।” সরকারি বাসে রাস্তার মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটলে বিমা বাবদ যে টাকা পাওয়ার কথা তা পরিবারটি পায়নি। সুনীতিবালা সদর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অপর্ণা বাগচি বলেন, “ওদের দুজনের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ার কোন অসুবিধা হবে না। আমরা আগেও সহায়তা করেছি। আগামী দিনেও করব।”

raja bandyopadhyay shining girl complicated disease madhyamik result jalpaiguri sunitibala higher secondary school shuvangana saha sangita hazra subhangana stunning result sangita hazra stunning result
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy