Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

উত্তরের কড়চা

শহরের গায়ে গায়ে যেমন থাকে গ্রাম, গ্রামের মধ্যেও তেমনই ঢুকে যাচ্ছে শহর একটু একটু করে। শহরের স্কুলের অষ্টম শ্রেণির দেবব্রত যদি ওর বন্ধু সুব্রতকে বলে বসে, “তুই কাল স্কুলত্‌ আসপু?” উত্তরে সুব্রত বলে, “আসমো না”আমাদের মানে বুঝতে কষ্ট হবে। বিভিন্ন এলাকার মুখের ভাষার যে নানা রূপ, তা শহরের মান্যতা না পেয়ে আস্তে আস্তে কি হারিয়ে যাচ্ছে?

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০২:১৪
Share: Save:

হারিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক শব্দ

শহরের গায়ে গায়ে যেমন থাকে গ্রাম, গ্রামের মধ্যেও তেমনই ঢুকে যাচ্ছে শহর একটু একটু করে। শহরের স্কুলের অষ্টম শ্রেণির দেবব্রত যদি ওর বন্ধু সুব্রতকে বলে বসে, “তুই কাল স্কুলত্‌ আসপু?” উত্তরে সুব্রত বলে, “আসমো না”আমাদের মানে বুঝতে কষ্ট হবে। বিভিন্ন এলাকার মুখের ভাষার যে নানা রূপ, তা শহরের মান্যতা না পেয়ে আস্তে আস্তে কি হারিয়ে যাচ্ছে? বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক নারায়ণ কুণ্ডু বললেন, “গ্রামের ছেলেরা শহরের স্কুলে পড়তে এলেও নিজের গ্রামের বন্ধুর সঙ্গেও এমন করে কথা বলবে না, পাছে শহুরে বন্ধুরা তাদের ‘গাঁইয়া’ ভাবে!” কিন্তু স্কুলে আসার সময় কোনও ছাত্র তার মাকে অনায়াসে বসতে পারে ‘মা, ভাত দি’। মা তার উত্তরে বলেন, ‘থাম, দ্যাছো’। শহরের মণিদীপা, শ্রীপর্ণা, অস্মিতা, মৃত্তিকারা তাই ‘হুচুত্‌ করিয়া আইছে দাদা/ হুচুত্‌ করিয়া কং/ দাদা আইছে বাপের বাড়ি নিয়া যাবার/ মন মোর নাই যাবার চান’ শুনে মজা পেলেও আবৃত্তির বেলায় সেই রবীন্দ্র-নজরুল, নয়তো জয়-শুভ, আর হালে সুবোধ। আঞ্চলিক ভাষায় এক সময় কবিতা চর্চা করতেন সুবীর চৌধুরী। তিনি বললেন, “আগে বালুরঘাটের পাড়ায় পাড়ায়, জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যে ভাবে আঞ্চলিক ভাষার কবিতা নিয়ে আগ্রহ থাকত, তা এখন স্তিমিতপ্রায়। শহরের নতুনরা কেউ ওই ভাষায় বলতেই চাইছেন না, চর্চা তো করছেনই না।” বালুরঘাট কো-এড কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রিপন সরকারের বক্তব্য, “শহরের নতুনরা তো বলছেই না, এমনকী তাদের বাবা-মায়েরাওগ্রাম ছেড়ে যাঁরা হয়তো সম্প্রতি শহরে এসেছেনতাঁরাও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে গেলেই আত্মসম্মানে লাগছে বলে টের পাচ্ছেন।” তিনি জানালেন, এমনকী যাঁদের বাড়ি এখনও গ্রামে, তাঁরাও শহরে এসে ‘কোটে যাছুস?’ বা ‘বালুরঘাটাত্‌’ ইত্যাদি কথা বা কথার টান সতর্ক ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন। মান্য ভাষাই ব্যবহার করছেন তাঁরা। রিপনবাবুর বক্তব্য, ‘করিচ্ছে’ (করছে), ‘চলিচ্ছে’ (চলছে), মারিচ্ছে (মারছে) বা ‘ধরিচ্ছে’ (ধরছে) কোনও অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় স্থান পেলেও তথাকথিত ভদ্র সমাজে পাচ্ছে না।

গোপন রহস্য

মোচা থেকে মুরগি। আবার মাছের ডিম, শুটকি বা চিংড়ি। বেসনের প্রলেপ মেখে ডুবে যাচ্ছে কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে, খানিকক্ষণের মধ্যেই গায়ে লালচে রঙ মেখে ভেসে উঠছে। এরপর আগুন লাল চামড়ার উপরে ছিটিয়ে দেওয়া বিট নুনের গুড়ো যেন ঠিক বরফকুচি। হাতে গরম হরেক কিসিমের চপের জন্যই লাইন পড়ে যায় আলিপুরদুয়ার ডিআরএম চৌপথীতে। একটি চৌকির উপরে কাঁচের বাক্স। ব্যস দোকান বলতে এতটুুকুই। কাঁচের বাক্সের ভিতরে চপের সম্ভার।

অন্তত ১৫ ধরণের চপ পাওয়া যায় এই দোকানে। দোকানের কোনও নাম নেই, তাই সাইনবোর্ডও নেই। শুধু স্বাদের টানেই তিন দশক ধরে দোকানের সামনে প্রতিদিন বিকেলে চপের লাইনে সামিল হন মানুষ। আলিপুরদুয়ারের খাদ্য রসিকেরা তো বটেই এমনকি দূরের চা বাগানগুলির ম্যানেজাররাও গাড়ি নিয়ে চপের টানে চলে আসেন চৌপথীতে। নিমাতি, রাজাভাখাওয়ার বাসিন্দাদেরও দেখা যায় চপের লাইনে। স্বাদের এমনই টান, কয়েক কিলোমিটারের দূরত্বও যেন তুচ্ছ। ত্রিশ বছর আগে দোকান খুলেছিলেন হরিপ্রসাদ দাস। এখন তিনি বৃদ্ধ। বছর কয়েক আগে ছেলে জগন্নাথবাবুর উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর এখন দোকানের ভার নাতি জয়ন্তবাবুর উপরে। জানা গেল, চপের জন্য প্রতিদিন প্রায় ২০ কেজি মুরগির মাংস, দেড়শো ডিম কেনা হয়। সকাল হতেই জয়ন্তবাবুদের বাড়িতে পরিবারের লোকেরাও কর্মীদের সঙ্গে চপ বানাতে হাত লাগান। তিন দশকে তিন পুরুষের হাত ধরেও চপের স্বাদ আর ভিড় বেড়েছে বই কমেনি। রহস্য কী? মুচকি হেসে জয়ন্তবাবু জানালেন, যাবতীয় রহস্য রয়েছে চপের মশালায়। যার রেসিপি পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কেউ জানেন না। ‘ট্রেড সিক্রেট’।

কর্মশালায় ফটোচর্চা

জলপাইগুড়ি শহরে কি ফোটোগ্রাফি চর্চা ছিল না? ছিল। স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু তার পরিধি ছিল ব্যক্তিগত স্তরেই সীমাবদ্ধ। সম্প্রতি এক ছাতার তলায় জড়ো হলেন তাঁরা। তৈরি হল জলপাইগুড়ি ফোটোগ্রাফিক অ্যাসোসিয়েশন। ফেস বুকে পেজ তৈরি করতেই সাড়া মিলল। গ্রুপে যোগ দিলেন শহর ও শহরতলির প্রায় ১১০০ জন শখের আলোকচিত্রী। ভারচুয়াল ওয়ার্ল্ড থেকে বাস্তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে পা রাখল জেলা স্কুল অডিটোরিয়ামে সারা দিন এক কর্মশালার মাধ্যমে। শুভাশিস ঘোষ, অনিকেত মোদক, বিশ্বপ্রিয় রাহুত, শৌভিক ঘোষ, বিপ্লব অধিকারীর মতো শহরে স্বনামখ্যাত শখের আলোকচিত্রীরা। ফোটোগ্রাফির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন তাঁরা। নিজেদের তোলা ছবির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন পোর্ট্রেট ফোটোগ্রাফির অ আ ক খ।

মাদুর গ্রাম

জেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ধলুয়াবাড়ি। কোচবিহারের এই এলাকার পরিচয় পাটির গ্রাম নামে। গ্রামের ২০ হাজার বাসিন্দার প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে শীতলপাটি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। কেউ উল বোনার মতো একটার পর একটা পাটি বুনতে দক্ষ, কারও আবার পাটি বুনে ময়ূর বা ফুলের নকশা তোলায় জুরি মেলা ভার। এই শীতলপাটিই রাষ্ট্রপতি পুরস্কার এনে দিয়েছিল ধলুয়াবাড়িকে।

ঘুঘুমারির বাসিন্দা পাটিশিল্পী নারায়ণচন্দ্র দে দক্ষ হাতে পাটি বোনার স্বীকৃতিতে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। আর এখন এই পাটির সৌজন্যে ধলুয়াবাড়ির আন্তর্জাতিক পরিচিতি। জাপান ও আরবের দেশগুলিতে গত দেড় মাস ধরে রফতানি হচ্ছে শীতলপাটি। ইতিমধ্যে দশ হাজারের বেশি পাটি পৌঁছে গিয়েছে ওই সব দেশে। তবে শুধু বিদেশের বাজার নয়,দেশের মানুষও এর কদর করুক, এমনটাই চান এখানকার পাটিশিল্পীরা। গ্রামের বাসিন্দারা দাবি করলেন, অন্য যেখানেই শীতল পাটি তৈরি হোক না কেন, সৃজনশৈলীতে কোচবিহারের ‘ভুসনাই’-এর জুড়ি মেলা ভার। শীতলপাটিকে যতটা সম্ভব মোলায়েম করে নিয়ে সূক্ষ্ম হাতে তা তৈরি করা হয় এখানে। পাটি ব্যবহারেরও নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। একবার এই পাটির আমেজ যারা পেয়েছেন, তারা বারবার আসতে বাধ্য হন বলে গর্ব করে জানালেন শিল্পীরা। দামও সকলের নাগালে। তিনশো টাকা থেকে সাত হাজার।

দেশি বাজনা

রাজবংশী বিবাহ রীতি উত্তরবঙ্গের লৌকিক দর্পণ। আর এ বিবাহ রীতিতে অন্যতম বিষয় হল লোকবাদ্য বা বাজনা। ওখানকার চলতি ভাষায় তা হল‘বাজেনা’। এ অঞ্চলে বিয়েতে বাজানো হয় সানাই, করকা, ঢোল, দম্ফ, ঝংকার সংবলিত দেশি বাজনা। রাজবংশী সমাজে দীর্ঘকাল ধরে পরম্পরাগত ভাবে এ ধরনের বাদক বা বাদিয়ারা বিয়ের অনুষ্ঠানকে করে তোলে মধুময় ও সুরেলা আবার একই সঙ্গে বিষাদঘনও। তাদের সানাইয়ের সুরে ফুটে ওঠে কন্যার অস্ফুট বেদনার প্রতিচ্ছবি। তার আকুলতার প্রতিচ্ছবি। সে প্রতিচ্ছবিতে ব্যক্ত হয় তার পিতার স্নেহের পরশ, মায়ের ব্যাকুলতা, আত্মীয় পরিজনের সমব্যথিতা। সেই সুরই আবার অন্য ঘরে জানান দেয় নববধূর আগমন বার্তা। ফলে তাদের সুরই পরিচয় বহন করে উত্তরের সংস্কৃতির লৌকিক পরম্পরা। গ্রাম্য লৌকিক জীবনে এ ধরনের শিল্পীর আনাগোনা আজও দেখা যায়। উত্তর বাংলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে এই শিল্পীদের দায়িত্ব যেন উত্তরের সংস্কৃতির স্পর্শে নবদম্পতিকে বরণ করা। এমনই একটি শিল্পী গোষ্ঠীর সন্ধান মিলল সম্প্রতি কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ ব্লকের শালবাড়ি বড়কুড়া গ্রামে। সারা বছর ধরে এরা দৈনন্দিন ব্যক্তিগত কাজের অবকাশে করেন সুরের সাধনা। বিয়ের অনুষ্ঠানে সমবেত ভাবে বিয়ের বাজনায় পরিবেশন করেন লৌকিক জীবনমুখী সুরের গাথা।

কচি-কাঁচাদের নাটক

রায়গঞ্জের তরুণ নাট্য সমাজ পরিচালিত প্রশান্ত সেনগুপ্ত মেমোরিয়াল চিলড্রেন ড্রামা স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। কিছু দিন আগে রায়গঞ্জে মঞ্চস্থ হল এদের নাটক ‘সভা চোর’। প্রশান্ত সেনগুপ্ত মেমোরিয়াল চিলড্রেন ড্রামা স্কুলের উদ্যোগে অরূপ মিত্র রচিত নাটকের অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে তমোঘ্ন, জয়িষ্ণু, শঙ্কু, শর্মিষ্ঠারা।

‘দ্য ফার্স্ট নকশাল’

মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে বাপাদিত্য পালকে ফোন করেছিলেন নকশাল নেতা কানু সান্যাল। তাঁর আত্মজীবনীর শেষ অনুচ্ছেদটি লেখা হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। সপ্তাহখানেকর পরেই অনান্য অনুচ্ছেদ্দগুলির মতো শেষ অংশটিও তাঁকে দেখিয়ে অনুমোদন নিয়ে আসার কথা জানিয়েছিলেন বাপ্পাদিত্য। যদিও, শেষ অংশটি দেখে যেতে পারেননি কানু সান্যাল। ২৬৪ পাতার পেপারব্যাকে প্রকাশিত হয়েছে সাংবাদিক বাপ্পাদিত্যের ‘দ্য ফার্স্ট নকশাল।’ কানু সান্যালের অনুমোদিত আত্মজীবনী। শিলিগুড়িতে বইটি পুনর্প্রকাশ হল। প্রয়াত নকশাল নেতার আত্মীয় ও সহযোগীরা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

রবীন্দ্রানুরাগিণী

‘মেরো শির নত গরিদেও তিমরো চরণতলমা, সারা অহংকার মেরো পখালিদেও আখাঁকো পানিমা।’ রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি গ্রন্থের প্রথম কবিতা, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’ কবিতাটির নেপালি ভাষার অনুবাদ। গীতাঞ্জলি গ্রন্থ নেপালি ভাষায় অনুবাদ করার কৃতিত্ব যাঁর তিনি রেমিকা থাপা। অধ্যাপনা করেন মালবাজার পরিমল মিত্র স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ে। রেমিকার জন্ম রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য মংপুতে।

রবীন্দ্রানুরাগিণী হওয়ার সূচনা হয়তো এখানেই। পড়াশোনা দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজে। তারপর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়ে কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন রেমিকা। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির প্রতি আকর্ষণ ছিল প্রথম থেকেই। ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথের কিছু রচনা নেপালি ভাষায় অনুবাদ করার। সে সুযোগ এসে যায় ২০০৮ সালে। রবিঠাকুরের ১৫০ তম জন্মবর্ষ উত্‌সবের প্রস্তুতি চলছিল। চলছিল গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ-সহ আরও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততা। রেমিকাদেবীর সুযোগ এসে যায় নেপালি ভাষায় গীতাঞ্জলি অনুবাদ করার। ২০০৮-এ কাজ শুরু করেন। শেষ হয় ২০১০ সালে। সিকিম আকাদেমি গীতাঞ্জলির নেপালি অনুবাদ প্রকাশ করে। তাঁর অনুবাদকর্মে খুশি রবীন্দ্রনুরাগীরা। অধ্যাপনা ও নানা পত্রপত্রিকায় লেখার কাজে ব্যাপৃত থেকেও গীতাঞ্জলির অনুবাদ করেছেন গভীর যত্ন সহকারে। তাঁর এই অনুবাদকর্ম প্রশংসা পাওয়ায়, আশা করা যায় নেপালি ভাষার মহাকবি ভানুভক্তের রচনা আমরা বাংলাভাষায় পেতে পারব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

uttar karcha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE