কী ভাবে প্রতি পদে টাকাপয়সা দিয়ে, অন্য লোককে ‘বাবা’ সাজিয়ে ছিটমহলের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করতে হয় সে কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছেন মালদহ কলেজের পড়ুয়া ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
শুক্রবার মালদহ কলেজে ভূগোল বিভাগের আলোচনা সভায় আমন্ত্রণ পেয়ে যোগ দিতে যান কোচবিহারের ছিটমহলের দুই কলেজ ছাত্র। তাঁরা শ্রোতাদের কাছে যখন নিজেদের জীবনের কথা তুলে ধরেন, কী কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁরা পড়াশোনা করছেন, আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন অনেকে।
ছিটমহলের ওই দুই ছাত্র জানান, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আগে তাঁদের নতুন ‘বাবা’ খুঁজতে হয়। নগদ টাকার বিনিময়ে নকল বাবা হওয়ার জন্য প্রথমে কাউকে রাজি করাতে হয়। কয়েক হাজার টাকা নেওয়ার পরেও নকল বাবারা শর্ত দেন, ধরা পড়লে কিন্তু সবই অস্বীকার করবেন তাঁরা। তাতেই রাজি হতে হয় ছিটমহলের পড়ুয়াদের অভিভাবকদের। সাধারণ নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিটমহলগুলিতে থাকেন একেবারেই গরিব মানুষেরা। ছেলেকে পড়াশোনা শেখাতে আসল বাবাই চাষবাস করে জমানো টাকা সেই নকল বাবার হাতে তুলে দেন। কখনও ধার দেনা করেও জোগাড় করতে হয় সে টাকা। তার পরে নকল বাবার হাত ধরে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জন্মের শংসাপত্র জোগাড় করে কোচবিহারে স্কুলে ভর্তি হতে হয় কচিকাঁচাদের।
ওই দুই পড়ুয়া বলেন, “পড়াশোনা করব বলে ভুয়ো সার্টিফিকেট দিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে হয়েছে। আমরা জানি যে এটা বেআইনি। কিন্তু আইনি পথে চলতে গেলে আমাদের আর পড়াশোনা করা হবে না। নিরুপায় হয়েই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে!” এখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। ছিটমহল সমস্যা সমাধানের একটা আলো দেখা যাচ্ছে। ছিটমহলের দুই পড়ুয়া এ দিন বলেন, “এত দিন আমরা আমাদের পরিচয় গোপন রাখতাম। এখন বুঝতে পারছি, এটা গোপন রাখার বিষয় নয়। আমাদের মতো হাজার হাজার মানুষ কী ভাবে বেঁচে রয়েছেন, তার মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, সে সব কথা প্রকাশ্যে আনাটা দরকার।” ‘ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’-র নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্তই দুই ছাত্রকে নিয়ে গিয়েছিলেন মালদহে। তিনি বলেন, “এই পড়ুয়াদের অভাব-অভিযোগের কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ। আশা করব, আগামী দিনে ছিটমহলের পড়ুয়ারা সব অধিকার পাবে।” তিনি বলেন, অনন্যোপায় হয়ে বেআইনি পথ নেওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করাটা পড়ুয়াদের এক ধরনের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ তাঁরা করছেন স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা প্রচলিত ব্যবস্থাটার বিরুদ্ধে।
কোচবিহারে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের মধ্যে রয়েছে ৫১টি ছিটমহল। এই ছিটমহলবাসীর নাগরিক পরিচয়পত্র নেই। পরিচয়পত্র না থাকার জন্য আজ তাঁরা শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো ন্যূনতম পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান না। এমনই একটি ছিটমহলের বাসিন্দা ওই দু’জনের এক জন পড়ছেন বাংলা নিয়ে, আর এক জন রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে।
মালদহ কলেজের ভুগোলের অধ্যাপক আনওয়ারুজ্জামান বলেন, “চলতি বছর বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ছিটমহলে সমীক্ষা করাতে গিয়েছিলাম। সেই সময় ওদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এ বার তারা নিজেদের কথা বলার সুযোগ পেল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy