সংকীর্ণ পথে এমন যানজট নিত্যদিনের রুটিন বালুরঘাটে। ছবি: অমিত মোহান্ত।
ভরা বর্ষায় সেই আগের মতোই চেহারা আত্রেয়ীর। কিন্তু অন্য সময়ে কেমন যেন হতশ্রী হয়ে যায় সীমান্ত শহর বালুরঘাটের বাসিন্দাদের একান্ত প্রিয় নদীটির চেহারা। জঞ্জাল, পাড় দখলের মতো সমস্যায় ক্রমশ গতি হারিয়ে ফেলছে নদীটি। নদী খাত যাতে ঠিকঠাক থাকে, পাড় যাতে দখল না হয় সে দিকে খেয়াল রাখা যে জরুরি সে কথা জানেন সকলেই। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর করাতে উদ্যোগীর বড়ই অভাব যেন। অন্তত নদীর পাড়ের জনপদের বাসিন্দাদের ধারণা এমনই।
আত্রেয়ীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ওই জনপদই হল বালুরঘাট। শতবর্ষের পুরানো শহর বালুরঘাটের বহিরঙ্গেও এখন পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে। শহর আগের চেয়ে অনেকটা দূরে ছড়িয়েছে। অতীতের তুলনায় অট্টালিকা বেড়েছে। যানবাহনও বেড়েছে। কিন্তু নাগরিক পরিষেবার পরিকাঠামো সেই অনুপাতে বাড়েনি। বাড়েনি রাস্তাও। ফলে আত্রেয়ীর মতোই নানা সমস্যায় ভূগছে উত্তরবঙ্গের অন্যতম পুরানো শহরটি।
একটু অতীতের দিকে চোখ ফেরানো যাক। শতবর্ষ আগে বালুরঘাট ছিল পতিরাম থানার অধীন এক বিখ্যাত নদী বন্দর। প্রবীণদের একাংশের মত অনুযায়ী, বালুরঘাট জনপদ প্রাচীনকালে ছিল পবিত্র বৈষ্ণবভূমি। তৎকালীণ বৈষ্ণবভুমির প্রাণ পুরুষ রবিলোচন মোহান্ত প্রথম তাঁর বাস ভবনের উত্তরদিকে খলাবাড়ি এলাকায় আত্রেয়ী নদীর ধারে রাধামাধবের মন্দির ও আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। আত্রেয়ী গতিপথ অনেকটা পশ্চিমে সরে গিয়েছে। কিন্তু শহরের মোক্তারপাড়ায় চালাঘরের সেই রাধামাধবের আখড়া আজ পাকা মন্দির হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আজ যেখানে বুড়াকালী মন্দির, আগে ছিল পুণ্যসলিলা আত্রেয়ী নদীর ঘাট। এই ঘাট বরাবর কিছুটা দূরে দূরে ছিল আরও অন্তত ৬ থেকে ৭টি কালীমন্দির। প্রবীণদের কয়েকজন জানান, তার মধ্যে দুটি ছিল ডাকাতে কালী মন্দির। চারদিক ঘন জঙ্গলে ভর্তি ছিল। ডাকাতে কালীর মধ্যে প্রথমটি ছিল বর্তমান আত্রেয়ী নদীর পরিত্যক্ত খাতে হোসেনপুরের ডাকরা চন্ডীমন্ডপ এবং দ্বিতীয়টি কংগ্রেসপাড়ায় স্বর্গত বিজয় সিকদার ও মহারাজা বসুর বাসগৃহ সংলগ্ন বর্তমান আত্রেয়ীর পাশের মশানকালী মন্দির।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে বালুরঘাট নদী বন্দর ক্রমশ বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে মফস্সল শহরের চেহারা নেয়। শহরের প্রবীণ বাসিন্দা, তথা বালুরঘাট পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বালুরঘাট শহরের উদ্ভব ওই বইরা কালী তথা বুড়াকালী ঘাট থেকেই। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে বুড়াকালীর ঘাট সরে আসে। কালীর স্থানের পরিবর্তন ঘটে। পরে নামটি অপভ্রংশ রূপে লৌকিক উচ্চারণে হয়ে দাঁড়ায়, বয়রার ঘাট। বয়রার অর্থ অর্চনা। কালক্রমে তা থেকে বালুরঘাট উচ্চারণ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় বলে অনেকে মনে করেন। আবার আত্রেয়ীর বালুময় ঘাট থেকে বালুরঘাট নাম প্রচলিত হয়েছে বলেও একটি মত রয়েছে। নামের উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে বিশেষজ্ঞদের আরও অনেক মত।
শহরের অনেকেই স্মৃতিচারণের সময়ে অনেক তথ্য জানিয়েছেন। তা সংক্ষেপে এরকম। এখন যেখানে জেলা পরিষদ বা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, তার পেছনে আত্রেয়ীর খাঁড়ি। উঁচু বাঁধের সিঁড়ি দিয়ে নেমে বর্তমান টাউন ক্লাবের মাঠ হয়ে ফেন্ডস ইউনিয়ন এবং হাইস্কুলের মাঠ হয়ে বরাবর মেরার মাঠ। বর্তমানে পাওয়ার হাউস এলাকার বেলতলা পার্কের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বাসিন্দাদের। প্রায় দু কিলোমিটার লম্বা ধূ ধূ মাঠের মাঝে ছিল একটি সয়রা গাছ। ওই গাছে ভূতের বাস ছিল বলে রটনা থাকায় নিঝুম দুপুরে ওই পথ ধরতে বিশেষ কেউ আগ্রহী ছিলেন না। গা ছমছম পরিবেশের মধ্যে সংলগ্ন টাউন ক্লাবের মাঠের পাশেই ছিল ‘মরাকাটা ঘর’। লোকে বলতেন, লাশ-কাটার ঘর অর্থাৎ বালুরঘাট হাসপাতালের মর্গ। সন্ধ্যরা পরে সেখানে যেতে সাহস করতেন না অনেকেই।
এখন সেই মর্গের সামনে গভীর রাতেই কিছু লোকজনের আনাগোনা দেখা যায়। অভিযোগ, মর্গ লাগোয়া এলাকায় নেশার আসরও বসে। ভূতপ্রেত নয়, এখন গভীর রাতে মাদকাসক্ত, নেশাগ্রস্তদের পাল্লায় যাতে পড়তে না হয়, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয় হাসপাতালে যাতায়াতকারীদের।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy