Advertisement
E-Paper

রূপকথার মতো বদলে গিয়েছে মাটিগাড়ার ছবি

ইংরেজ আমলের কথা। ‘সানডে’ হলেই সাহেবদের ঘোরাঘুরি শুরু হতো শিলিগুড়ি লাগোয়া ছোট্ট জনপদের দিকে। রবিবার বিকেলের মধ্যেই সেখানে জড়ো করা হতো দূর-দূরান্তের ছোট-বড় নানা মাপের হাতি। নানা জাতের ঘোড়া। কোন এলাকা থেকে কটা হাতি এল। সাদা ঘোড়া কটি এসেছে? কালো ঘোড়া কেমন পোষ মানবে? এমন খোঁজখবর শুরু হতো।

কিশোর সাহা

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:১৮
মাটিগাড়া তখন। নয়ের দশকে চাঁদমণি চা বাগানের পথ ধরে চলেছেন শ্রমিকেরা।

মাটিগাড়া তখন। নয়ের দশকে চাঁদমণি চা বাগানের পথ ধরে চলেছেন শ্রমিকেরা।

ইংরেজ আমলের কথা। ‘সানডে’ হলেই সাহেবদের ঘোরাঘুরি শুরু হতো শিলিগুড়ি লাগোয়া ছোট্ট জনপদের দিকে। রবিবার বিকেলের মধ্যেই সেখানে জড়ো করা হতো দূর-দূরান্তের ছোট-বড় নানা মাপের হাতি। নানা জাতের ঘোড়া। কোন এলাকা থেকে কটা হাতি এল। সাদা ঘোড়া কটি এসেছে? কালো ঘোড়া কেমন পোষ মানবে? এমন খোঁজখবর শুরু হতো। তরাই, ডুয়ার্স তো বটেই, নেপাল, ভুটান, সিকিমের অনেক অভিজাত পরিবারের প্রতিনিধিরাও হাজির হতেন সোমবারের মধ্যেই। কারণ, মঙ্গলবার সকাল হলেই কেনাবেচার শুরু। সে জন্য সম্ভাব্য পোষ্যের সম্পর্কে যতটা সম্ভব জেনে নেওয়ার জন্য চলতে লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদ। দরাদরির পরে হাতি-ঘোড়া কিনে ক্রেতারা বেলাবেলি রওনা হয়ে যেতেন। দুধারে চা বাগান। মাঝখান দিয়ে হেলেদুলে চলছে হাতি। বাগানের মধ্যেকার ছোট পথ দিয়ে টগবগ করে ছুটছে ঘোড়া...।’

কোনও কল্পিত ছবি নয়। ৭০-৮০ বছর আগেও এমন দৃশ্য দেখা যেত মাটিগাড়া হাটে। যা কি না মাটিগাড়া-শিলিগুড়ি-নকশালবাড়ির প্রবীণদের অনেকেরই নিজের চোখে দেখা। সেই হাতি, ঘোড়া, গরু, ছাগল-সহ নানা পশুর হাটের জন্যই দেশ ছাড়িয়ে, লাগোয়া বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে মাটিগাড়ার নাম। একেবারে অজ পাড়াগাঁ থেকে মাটিগাড়া আচমকা যেন রূপকথার রাজপুত্তুরের মতো পাল্টে গিয়েছে।

যেখানে ছিল মাইল-মাইল চা বাগান। সেখানে এখন ঝাঁ চকচকে সিটি সেন্টার। যে নদীর ধারে ঝোপে ছিল সাপ-শেয়ালের আস্তানা। আবর্জনার স্তূপ। তা অদৃশ্য। সেখানে এখন অত্যাধুনিক মানের হাসপাতাল। কোথাও গড়ে উঠেছে বেসরকারি উদ্যোগে আইন কলেজ। কোথাও আবার সরকারি উদ্যোগে বিজ্ঞান কলেজ। হাজারো পাখির ওড়াওড়ি ছিল যে এলাকায়, সেখানে এখন হাজারো অট্টালিকা। কয়েক দশক আগে যতটা সবুজ ছিল মাটিগাড়া, এখন ততটাই যেন কংক্রিটে মোড়া একটা চেহারা নিচ্ছে। চাঁদমণি উপড়ে উপনগরী যতটা পরিকল্পিত, ততটাই অপরিকল্পিত ভাবে বহুতল গড়ে উঠছে মাটিগাড়ার অন্য সব এলাকায়। কোথায় কতটা রাস্তা হওয়া দরকার, সাফাইয়ের পরিকাঠামো কতটা থাকা বাধ্যতামূলক, পানীয় জলের ব্যবস্থা করা কতটা জরুরি, সে সব নিয়ে প্রোমোটারদের একাংশের যেন কোনও হেলদোল নেই। তাই মাটিগাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

মাটিগাড়া এখন। ঝাঁ চকচকে সিটি সেন্টার।

ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাটিগাড়ায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। নিত্যনতুন বহুতল তৈরির অনুমতি দিচ্ছে সরকার। অথচ দৈনন্দিন নাগরিক পরিষেবার মান বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারি তরফে কেউ উদ্যোগী হচ্ছেন না। বামেদের আমলেও মাটিগাড়ার দাবি-দাওয়া নিয়ে আশ্বাস দিয়েছেন তখনকারী নেতা-মন্ত্রীরা। তৃণমূল সরকারের নেতা-মন্ত্রীরাও আশ্বস্ত করছেন মাটিগাড়াকে। কাজের কাজ কিন্তু হয়নি। বরং বাম আমলের চেয়ে ইদানীং মাটিগাড়ায় সরকারি জমি দখলের প্রবণতা বেড়েছে। একশ্রেণির জমির দালাল ও নেতাদের একাংশের যোগসাজশে রাতারাতি সরকারি জমি দখল করে গড়ে উঠছে ঘরদোর, দোকানপাট।

অবশ্য মাটিগাড়ার মাটির কদর নতুন কিছু নয়। এলাকার প্রবীণদের মুখে শোনা যায়, একটা সময়ে মাটিগাড়া থেকেই প্রচুর মাটি নিয়ে শিলিগুড়ি শহরের নীচু জায়গা ভরাট করে জনবসতি গড়া হয়েছে। তা থেকেই মাটিগাড়া নামের চল বলে অনেকে মনে করেন। যেমন, লেখক ও পর্যটক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “মাটিগাড়ার মাটি তো শিলিগুড়ি নগরীর পত্তনের ভিত তৈরি করেছে। তা থেকেই হয়তো মাটিগাড়া।”

এটা বলার পরেই স্মৃতিতে ডুবে যান তিনি। তাঁর গলায় শোনা যায়, সবুজে সবুজ সেই মাটিগাড়ার কথা। ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই মাটিগাড়া-হাটের কথা। চাঁদমণিতে শিবরাত্রির মেলার পুরানো দৃশ্যের হুবহু বর্ণনা দিয়ে গৌরাশঙ্করবাবু বলেন, “নদী, চা বাগান ঘেরা মাটিগাড়ার আকর্ষণটাই ছিল অন্যরকম। টাটকা বাতাস। টাটকা শাক-সব্জি। কিন্তু, গত তিন দশকে মাটিগাড়া যেন হু হু করে বদলে গেল। চা বাগানের জায়গায় গড়ে উঠল উপনগরী। জাতীয় সড়কের অন্য পাশে একচিলতে চা বাগান রাখতে হবে বলে শর্ত ছিল শুনেছি। সেটাও হারিয়ে যেতে বসেছে।”

এই বদলে যাওয়াটা হয়তো অনিবার্য। কিন্তু, বদলে যাওয়ার সঙ্গে ভারসাম্য রেখে এলাকার পরিকাঠামোর উন্নয়নও করা ভীষণ দরকার। এমনই মনে করেন মাটিগাড়ার প্রবীণ বাসিন্দাদের অনেকেই। তাঁরা সকলেই আক্ষেপ করেন, শতবর্ষ প্রাচীন মাটিগাড়া হাট ‘হেরিটেজ’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারত। নেতা-কর্তাদের সদিচ্ছা থাকলে ওই হাটকে ঘিরেই এলাকার অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টানোর চেষ্টা করা যেত। সেই হাটের এখন কী হাল তা একজরে দেখে নেওয়া যাক।

দু’টি ছবিই তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।
(চলবে)

amar shohor kishore saha matigara
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy