Advertisement
E-Paper

শুধু নতুন জেলা গঠন করাই যথেষ্ট নয়

একটি দিনের কথা মনে পড়ে। বিশেষ প্রয়োজনে জলপাইগুড়ি সদরে যাচ্ছি আমি আর বাবা। সকালবেলায় ফার্স্ট বাস ধরব। আলিপুরদুয়ার থেকে জলপাইগুড়িগামী বাস কালচিনি আসবে সকাল সাড়ে ছ’টায়। তারই মধ্যে কালচিনি চৌপথিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। কোনও ভাবে এই বাস ধরতে না-পারলে জলপাইগুড়ি যাওয়ার বাস আবার সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পরে। আগে যেতে চাইলে বীরপাড়া গিয়ে বাস বদলে নিতে হবে।

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০২:২৪
জেলা ভাগের ঘোষণার খুশিতে আলিপুরদুয়ারে মিষ্টিমুখ আইনজীবীদের। ছবিটি তুলেছেন নারায়ণ দে।

জেলা ভাগের ঘোষণার খুশিতে আলিপুরদুয়ারে মিষ্টিমুখ আইনজীবীদের। ছবিটি তুলেছেন নারায়ণ দে।

একটি দিনের কথা মনে পড়ে। বিশেষ প্রয়োজনে জলপাইগুড়ি সদরে যাচ্ছি আমি আর বাবা। সকালবেলায় ফার্স্ট বাস ধরব। আলিপুরদুয়ার থেকে জলপাইগুড়িগামী বাস কালচিনি আসবে সকাল সাড়ে ছ’টায়। তারই মধ্যে কালচিনি চৌপথিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। কোনও ভাবে এই বাস ধরতে না-পারলে জলপাইগুড়ি যাওয়ার বাস আবার সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পরে। আগে যেতে চাইলে বীরপাড়া গিয়ে বাস বদলে নিতে হবে।

ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়েছে। আকাশ ঘন কালো করে বর্ষা এসেছে, যেমন আসে এই পাহাড়ঘেরা সবুজরঙা ডুয়ার্সে। ভোর হয়েছে, পাখিরা জেগেছে, তবু ঘরে আমাদের বাতি জ্বলছে। মেঘের আঁধার আড়াল করে রেখেছে সকালের আলো। এমন বাদলায় যেতে হবে তিন ঘণ্টার পথ। প্রায় দেড়শো কিলোমিটার পিচ-ওঠা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে, টইটম্বুর নদীর উপর থরো থরো সেতুর উপর দিয়ে। কিন্তু যেতে আমাদের হবেই। বড় জরুরি কাজ সেখানে। রোজ রোজ বাবার ছুটি মিলবে না। রবিবারে সরকারি দফতরখানা বন্ধ। এক দিনে কাজ মিটবে সেই ভরসা নেই। তেমন হলে রাতে হোটেলে থাকতে হবে।

এই মনে পড়া কেবল আমার নয়। আমরা যারা জেলা জলপাইগুড়ির একেবারে উত্তর প্রান্তের বাসিন্দা, তোর্সা, কালজানি, পানা, বুড়িবাসরার কোলে জীবনযাপন করি, আমাদের সবার এমন সব দিন কাটে। আমাদের সময়ের কোনও দাম নেই। মানসম্মানও কি খুব আছে? একটা জেলা শুধুমাত্র একটা শহর কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে এতকাল। সে ওই জলপাইগুড়ি শহর। বাকি সব জনপদই তুচ্ছ। নিম্ন মানের। এমনকী সদরের মানুষও যে আমাদের মতো প্রত্যন্ত চা-বাগানের মানুষজনকে আমল দিতে চায় না, সে বেশ বুঝেছিলাম এক বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে। আজও তার চালচিত্র খুব কিছু পাল্টায়নি। তাই, অনিবার্য ভাবেই শুরু হয়েছিল আলিপুরদুয়ারকে পৃথক এক জেলার স্বীকৃতি দেওয়ার আন্দোলন। বর্তমান সরকার তার ঘোষণা করল।

যদি বলি, এই বিভাজনে মন কেমন করছে, মিথ্যে বলা হবে। বরং, আমাদের ডুয়ার্সের অধিবাসী-বৃন্দের দিনযাপনে সুযোগ-সুবিধা আসবে ভেবে খুব ভাল লাগছে। আলিপুরদুয়ার জেলা শহর হয়ে উঠবে। সরকারি কার্যালয় গড়ে উঠবে। আশা করা যায়, আলিপুরদুয়ারের ধুঁকতে থাকা সরকারি হাসপাতালে মানোন্নয়ন হবে। শুধুমাত্র কয়েক লক্ষ ডুয়ার্সবাসীর অভিমানকে প্রশ্রয় দিয়ে ভোটব্যাঙ্ক চাঙ্গা রাখাই যদি জলপাইগুড়ি বিভাজনের একমাত্র উদ্দেশ্য না-হয়, সরকারি পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি উন্নয়ন লাভ করবে আশা করা যায়।

প্রাথমিক ভাবে, শুধুমাত্র নবগঠিত জেলা হিসাবেই কিছু উন্নতি দেখা দেবে। পুরোদস্তুর জেলাশাসক দফতর পাওয়া যাবে। ভাল রাস্তা হবে। জমির দাম বাড়বে এবং এই বৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছে থেমে যাবে। তারপর?

যে কোনও অঞ্চল তার ভৌগলিক গঠনের উপর নির্ভর করে বিকাশ লাভ করে। আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রিক ডুয়ার্সে প্রকৃতি কৃপণ নয়। পর্যটনের পক্ষে আকর্ষণীয় সৌন্দর্য আছে, সুফলা ক্ষেত্র আছে, নদী-নালা প্রচুর, আছে অরণ্য ও প্রাণিসম্পদ আর চা বাগান। যার বহর, উৎপাদন ক্ষমতা, রফতানিযোগ্য উৎপন্ন দ্রব্য চা, বিদেশি অর্থ আনয়ন ক্ষমতা এবং কর্মিসংখ্যার নিরিখে একে ভারী শিল্পের মর্যাদা না-দেওয়ার কারণ নেই। বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক জটিলতায় চা-বাগানগুলি ধুঁকছে। নতুন জেলার ঘোষণা চা শিল্পের পক্ষে সুফলদায়ী হতে পারবে কি? নাকি এই দস্তুর সাজানোই সার।

জীবনের সুরক্ষা এবং উন্নতির জন্য একটি নতুন জেলা গঠনই যে যথেষ্ট নয়, সরকারকে তা বুঝতে হবে।

new district tilottama majumder
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy