তিনি মুখ খোলা মানেই ইদানীং বিতর্ক। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার ইঙ্গিতের পরে মুকুল রায়ের সঙ্গে আলোচনায় ‘না’ নয়! সিপিএমের অন্দরে ফের তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী বুধবার তাঁকে ফের বুঝিয়ে বলেছে, এমন অসতর্ক মন্তব্য এড়িয়ে চলতে। তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর লক্ষ্য মাথায় রেখে নিজের কৌশল থেকে পিছু হঠতে নারাজ গৌতমবাবু!
কলকাতায় মমতা এবং দিল্লির মসনদ থেকে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে তৃণমূল ও বিজেপি-বিরোধী নানা শক্তিকে একজোট করা নিয়ে এখন চর্চা চলছে বাম শিবিরের একাংশে। যে প্রচেষ্টার প্রবক্তা হিসাবে গৌতমবাবু মাঝেমধ্যে মুখ খুলে সেই চর্চাকে প্রকাশ্যে আনছেন। আবার অন্য দিকে তৃণমূলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় ও তাঁর অনুগামীরাও নিজেদের মতো ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল ও বিজেপি-বিরোধী মঞ্চে কি মুকুল নতুন দল নিয়ে আসতে পারেন? এই প্রশ্নের জবাবেই মঙ্গলবার বারাসতে গৌতমবাবু বলেছিলেন, মুকুল আলোচনা করতে আসতেই পারেন। রাজনীতিতে ‘না’ বলে কোনও কিছু হয় না! তাঁর এই মন্তব্য নিয়েই প্রবল অস্বস্তিতে পড়েছে সিপিএম। বিব্রত হয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক স্বয়ং সীতারাম ইয়েচুরিও। কিন্তু বৃহত্তর লক্ষ্যে গৌতমবাবু তাঁর কৌশল বদলানোর কোনও কারণ দেখছেন না!
সিপিএমের একটি বড় অংশের বক্তব্য, দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকের স্নায়ুগত সমস্যা এখন প্রবল। অসুস্থতার মধ্যেই সংবাদমাধ্যম বারবার তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে বিতর্ক তৈরি করছে! গৌতমবাবুর নিজেরও ব্যাখ্যা, নানা রকম ওষুধ খেতে হয় তাঁকে। তার মধ্যে দীর্ঘক্ষণ কথা বললে গলা শুকিয়ে অসুবিধায় পড়তে হয়। বারাসতে মঙ্গলবার সংখ্যালঘুদের কনভেনশনেও দীর্ঘ বক্তৃতার পরে ক্লান্ত ছিলেন। সেই সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর প্রথমে দিতে চাননি। কিন্তু তার পরেও পীড়াপীড়ির মুখে তিনি মুকুল-প্রশ্নে যা বলেছিলেন, তাতে অন্যায় কিছু ছিল না— এমনই মনে করছেন গৌতমবাবু। দলে বিতর্ক হচ্ছে জেনেও বুধবার তিনি বলেছেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, রাজনীতিতে ‘না’ কখনও স্থায়ী শব্দ হতে পারে না। এর মানে কি আমি মুকুলকে ডেকে জোট করতে বলেছি? যা বলেছি, তার নিজস্ব ব্যাখ্যা সংবাদমাধ্যম করেছে!’’
বিচক্ষণ রাজনীতিক গৌতমবাবু জানেন, ‘না’ বলে কিছু হয় না— এই মন্তব্যের অবধারিত অর্থহয় তিনি মুকুলের জন্য দরজা বন্ধ করছেন না! কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনার দরজা যখন তিনি খোলা রেখেছিলেন, দলের মধ্যেই একাংশ পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু মুকুল-প্রশ্নে সেই সমর্থনও নেই! দলের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠদেরই সাফ কথা, মমতার সঙ্গে দূরত্ব হলেও মুকুল সারদা কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত। তাঁর সঙ্গে সমঝোতা করতে গেলে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা কী থাকবে? সে কারণেই আলিমুদ্দিনে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে গৌতমবাবুকে বার্তা দেওয়া হয়েছে অভিজ্ঞ নেতা হিসেবে এমন মন্তব্য এড়িয়ে চলতে।
কিন্তু তিনি যে-হেতু গৌতম দেব, তাই সরাসরি মুকুলের পক্ষে সওয়াল না করেও লক্ষ্য ভুলছেন না! তাঁর মন্তব্য, ‘‘ভোটের ভাবনা ভোটের সময় ভাবতে হবে। আমি তো বলছি, প্রাথমিক লক্ষ্য মমতাকে হঠানো। পরিস্থিতি বিচার করে তার জন্য একটু বাড়তি পথ হাঁটতে হবেই। উই শ্যাল হ্যাভ টু ওয়াক দ্যাট এক্সট্রা মাইল!’’ এই অতিরিক্ত পথ হাঁটার মানে কী, সেই পথের সঙ্গীই বা কারা হতে পারেন, সেই ব্যাপারে কোনও মন্তব্য না করে জনমানসের উপরেই গোটা ব্যাখ্যা ছেড়ে দিচ্ছেন গৌতমবাবু!
তাঁর এই কৌশলের জেরে অবশ্য বিড়ম্বনা সামলাতে হচ্ছে ইয়েচুরিকে! এই ধারণাই এখন সব মহলে জনপ্রিয় যে, ইয়েচুরি নিজে যে হেতু কংগ্রেসের প্রতি উদারপন্থী, তাই তাঁর প্রশ্রয় নিয়েই গৌতমবাবু নানা মন্তব্য করে যাচ্ছেন! আগে এক বার বিবৃতি দিয়ে ইয়েচুরিকে বলতে হয়েছিল, কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও ফ্রন্ট বা নির্বাচনী সমঝোতা করা তাঁদের পার্টি কংগ্রেস, কেন্দ্রীয় কমিটি বা রাজ্য কমিটির সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু তার পরেও গৌতমবাবু কংগ্রেস-দরজা বন্ধ তো করেনইনি, বরং মুকুল-জানলা খুলেছেন! এ বার কি তা হলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হবে? ইয়েচুরি এ দিন বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস সম্পর্কে তাঁর যে মন্তব্য সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছিল, তার পরে গৌতম চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, তিনি ও কথা বলেননি। আবার যদি একই কথা বলে থাকেন, খোঁজ নিতে হবে!’’ সাধারণ সম্পাদকের সংযোজন, ‘‘আমি বলছি না, সংবাদমাধ্যম কিছু বিকৃত করছে। কিন্তু গৌতম মঙ্গলবার কী বলেছেন, রিপোর্ট নিতে হবে।’’ দলেরই এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের অবশ্য সরস মন্তব্য, ‘‘মুকুলকে নিয়ে পার্টি কংগ্রেসে তো সিদ্ধান্ত হয়নি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy