Advertisement
E-Paper

ক্যানসারে নিঃস্বদের পাশে ডাক্তাররাই

বীরভূমের নানুরের গাঁধপুর গ্রামের বাপি দাসের ১৪ মাসের ছেলে সৌবর্ণর রক্তের ক্যানসার। মার্চ মাস থেকে স্ত্রীকে নিয়ে নীলরতন মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে ত্রিপল টাঙিয়ে দিন কাটাচ্ছেন দিনমজুর বাপি। চার মাস রোজগার নেই।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৫
গৌতম সিংহ  ও সৌবর্ণর বাবা বাপি দাস। হাতে ছেলের ছবি এবং অভিজিৎ ঘোষাল। — নিজস্ব চিত্র

গৌতম সিংহ ও সৌবর্ণর বাবা বাপি দাস। হাতে ছেলের ছবি এবং অভিজিৎ ঘোষাল। — নিজস্ব চিত্র

বীরভূমের নানুরের গাঁধপুর গ্রামের বাপি দাসের ১৪ মাসের ছেলে সৌবর্ণর রক্তের ক্যানসার। মার্চ মাস থেকে স্ত্রীকে নিয়ে নীলরতন মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে ত্রিপল টাঙিয়ে দিন কাটাচ্ছেন দিনমজুর বাপি। চার মাস রোজগার নেই। বাড়িতে অনেকগুলি মুখ, তাঁরই রোজগারের দিকে তাকিয়ে। তবে বাপিকে নবান্নে যেতে হয়নি। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের এক দল সরকারি ক্যানসার চিকিৎসকই বাপির জন্য ওই হাসপাতালে জোগাড় করে দিয়েছেন মজুরের কাজ। নিজেরা চাঁদা তুলে ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাপির গ্রামের বাড়িতে।

আমর্হাস্ট স্ট্রিটের অভিজিৎ ঘোষালের কিডনিতে ক্যানসার। ওরাল কেমো হিসেবে আরজিকর থেকে বিনা পয়সায় যে ওষুধটি মিলছিল তা আপাতত হাসপাতালে অমিল। বিকল্প ওষুধও হাসপাতালে নেই। বাজারে ওই ওষুধের ৯০ টি-র দাম সাড়ে তিন লক্ষ টাকা। এখানেও এগিয়ে এসেছেন ওই সরকারি চিকিৎসকেরা। ওই ওষুধ ও কিছু দামি শারীরিক পরীক্ষার যাবতীয় খরচ জোগাড় করে দিচ্ছেন তাঁরাই।

ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁদের যে সর্বস্ব চলে যেতে পারে, সেই প্রস্তুতি নিয়েই হাসপাতালে এসেছিলেন সৌবর্ণ আর অভিজিতের পরিবার। কিন্তু তা হয়নি। বরং যখন প্রায় প্রতিদিন সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের মার খাওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন চিকিৎসকদেরই দেবতার আসনে বসিয়েছেন গৌতম সিংহ, বাপি দাস, স্বপন দে, রবি পাকড়ে, অরিজিৎ ঘোষাল, মন্টু পাসোয়ান, রামপ্রসাদ দাস, অচিন্ত্য মণ্ডল, রঞ্জন মুখোপাধ্যায়রা। ওঁদের কেউ নিজেরাই ক্যানসার রোগী, কারও নিকটাত্মীয় ভর্তি সরকারি হাসপাতালে। তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আরজিকর, বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ, বর্ধমান মেডিক্যাল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের এক দল ক্যানসার বিশেষজ্ঞ।

রোগের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ওই চিকিৎসকেরা দেখেছেন এই রোগে আক্রান্তেরা কী ভাবে তিলেতিলে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। যা প্রচণ্ড ভাবে মানসিক চাপে ফেলছে রোগীদেরও। তাই শুধু চিকিৎসা নয়, সব দিক দিয়ে ওই সব রোগী ও তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে আশার আলো দেখাচ্ছেন ক্যানসার চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। একটি সংগঠন তৈরি করে তাঁরা নেমে পড়েছেন অন্য এক লড়াইয়ে।

বাপি দাস বলছিলেন, ‘‘আমার ছেলেটার সিএসএফ সাইটোলজি, কেরিওটাইপিং-এর মতো পরীক্ষা করাতে হয়। কিন্তু হাসপাতালে অনেক দেরি হয়। অপেক্ষা করলে ওর রোগ আরও বেড়ে যাবে। তাই বাইরে থেকে ৭-৮ হাজার টাকায় এখন ওই পরীক্ষা করাচ্ছি। টাকা দিচ্ছেন ডাক্তারবাবুরা। জ্বর এলেও কিছু পরীক্ষা করাতে হয়। তার টাকাও ওঁরা দেন।’’

চিকিৎসকদের কথা বলতে গিয়ে চোখে জল চলে এসেছিল গৌতম সিংহের। তিনি বলেন, ‘‘বিয়ের চার মাসের মধ্যে গলার ক্যানসার ধরা পড়ে। আমার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাতাম। সেই রোজগারটাও বন্ধ হয়ে গেল। পেট সিটি স্ক্যানের জন্য কিছু দিন বাদে-বাদেই ১৫ হাজার টাকা লাগে। কেমোর বেশ কিছু ওষুধও কিনতে হয়। আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। এখন যা টাকা লাগার দিচ্ছেন ডাক্তারবাবুরাই। ওষুধ সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে ফ্রি স্যাম্পেল আনিয়ে দিচ্ছেন।’’

চিকিৎসার জন্য বহু গরিব মানুষকে প্রতিদিনের কাজকর্ম ছেড়ে, জীবিকা হারিয়ে হাসপাতালে এসে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হয়। ডাক্তারবাবুরা টাকা তুলে তাঁদের থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের টাকার সংস্থানও করছেন। জানিয়েছেন বাপির মতো অনেকেই।

কীসের তাগিদে এমন কাজ করছেন ওই চিকিৎসকেরা? আরজিকরের অঙ্কোলজির প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়, বর্ধমান মেডিক্যালের অঙ্কোলজির প্রধান প্রদীপ মাইতি, বহরমপুর মেডিক্যালের অঙ্কোলজির প্রধান অমিত চক্রবর্তী, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অমিতাভ মান্নারা নিজেদের মুখে তাঁদের কাজ সম্পর্কে খুব একটা কিছু বলতে চাইলেন না। একটাই বার্তা দিতে চান তাঁরা— ‘রোগীদের সংখ্যার চাপে সরকার চাইলেও হয়তো প্রত্যেককে সম্পূর্ণ পরিষেবা দিতে পারে না। কিন্তু চেষ্টা করলে চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রেই গরিব রোগীর পাশে দাঁড়াতে পারেন। আর সেই মানবিকতার ছোঁওয়ায় যে পারস্পরিক ভরসার বাতাবরণ তৈরি হয়, তা অমূল্য।’

cancer patient doctor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy