পিঠেপুলি। নিজস্ব চিত্র
মকরসংক্রান্তির দু’-এক দিন আগে থেকেই কেমন যেন উতলা হয়ে উঠতেন গৌর অধিকারী। চোখটা কেবলই চলে যেত দোকানের সামনের রাস্তার দিকে। মাজদিয়া স্টেশন থেকে বরাবর চলে এসেছে রাস্তাটা। কিন্তু কই, এখনও তো তিনি এলেন না!
প্রতীক্ষা এক সময়ে শেষ হত। তিন চাকার ভ্যানরিকশায় সওয়ার হয়ে সরাসরি তাঁর দোকানে উপস্থিত হতেন সাহিত্যিক বিমল মিত্র। কনকনে শীতের সকালে পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবির উপরে শাল জড়িয়ে গৌর অধিকারীর দোকানে নেমেই খোঁজ নিতেন খেজুরগুড়ের রসগোল্লার! গৌরবাবু এই জন্যেই অপেক্ষা করতেন। নিজের হাতে বানানো স্পেশ্যাল গুড়ের রসগোল্লা তুলে দিতেন ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বা ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর লেখকের হাতে।
এ ভাবেই সাতের দশকে পৌষ সংক্রান্তি উদ্যাপন করত সে কালে মাজদিয়া বা ফতেপুর। আসলে সাহিত্যিক বিমল মিত্রের পৈত্রিক বাড়ি ছিল নদিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা ফতেপুরে।
বছরে দু’বার নিয়ম করে বাড়ি ফিরতেন তিনি। এক বার আমের সময়ে আর এক বার পৌষে নতুন গুড়, পিঠেপুলির সময়ে। উঠতেন অমরেশ বরের বাড়িতে। যে ক’দিন থাকতেন, তাঁকে ঘিরে জমাটি আড্ডার আসর বসত। অফুরন্ত খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে অনর্গল গল্পেই যেন পৌষ আগলাতেন সবাই। ঘরের এক কোণে বসে সে সব গল্প শুনতেন বছর সতেরোর দুই বন্ধু উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় আর স্বপন ভৌমিক। এখনও মধ্য ষাটের দুই প্রবীণ পৌষ সংক্রান্তি এলেই মজে যান সেই গল্পে।
মাজদিয়ার গৌর অধিকারীর সেই দোকান এখনও আছে। বদলেছে মালিক। দায়িত্ব এখন গৌরবাবুর ছেলে গোপাল অধিকারীর হাতে। তাঁর শৈশব স্মৃতিতেও বিমল মিত্তির আছেন। গোটা শীত জুড়েই বিক্রি হয় গুড়ের রসগোল্লা।
তবে পৌষ সংক্রান্তি এলেই হরেকরকম পিঠেপুলিতে সাজিয়ে তোলেন দোকান। সংক্রান্তির দিন রীতিমতো লাইন দিয়ে সেই সব মিষ্টি কেনেন এলাকার মানুষ।
তিনি জানান, “এবারে চার পাঁচ রকম বানিয়েছি। পাটিসাপটা, ভাজাপিঠে, গোকুল পিঠে আর চন্দ্রপুলি।”
তবে শুধু তাঁর দোকান বলে নয়, শীতের এই মরসুমি পুলিপিঠের চাহিদার কাছে হালে পানি পাচ্ছে না অন্যান্য ধ্রুপদী মিষ্টি। শীতের মরসুমে, বিশেষ করে, পৌষ সংক্রান্তির এই সময় থেকে ঘরোয়া মিষ্টির দাপটে রীতিমতো কোণঠাসা চেনা মিষ্টির দল। পিঠেপুলি, পাটিসাপটা, রসবড়ার ভিড়ে মিষ্টির দোকানের শো-কেসে রসগোল্লা-সন্দেশ পিছু হটে একেবারে দ্বিতীয় সারিতে। নলেন গুড়ের সন্দেশ এবং রসগোল্লা ছাড়া অন্য মিষ্টির বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসে।
এমনটাই জানাচ্ছেন বিভিন্ন মিষ্টির দোকানের মালিকেরা। এমনকি, শীতের ভোজের পাতেও ঠাঁই পাচ্ছে গোকুল পিঠে বা ক্ষীরের পাটিসাপটার দল। জায়গা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে সন্দেশ, রসগোল্লা। চলতি মরসুমে একাধিক বিয়ে বা অন্নপ্রাশনের ভোজে শেষপাতে গোকুল পিঠে বা পাটিসাপটার বরাত পেয়েছেন ক্যাটারিং ব্যবসায়ী শান্তুনু ভৌমিক, নিতাই বসাকেরা।
তাঁরা জানাচ্ছেন, এবারে যেটা নতুন, তা হল— সবটাই লাইভ। মানে পাটিসাপটা হাতে গরম ভেজে সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশন করা। যেমনটা মেলার মাঠে হয়। লোকে যখন খুশি খেতে পারে। অনেক পিকনিকে জলখাবারে পুলিপিঠের অর্ডার থাকছে।
বাঙালির পিঠে-প্রেমের ধারাবাহিকতা অবশ্য প্রশ্রয়ই পাচ্ছে মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের কাছে। বেশির ভাগ শহর বা গ্রামের দোকানে মিলছে শীতের পিঠেপুলি। স্বাদে চমৎকার সেই সব এক দিকে যেমন আক্ষেপ মিটিয়ে দিচ্ছে, তেমনই বিক্রিও ক্রমশ বাড়ছে। এমনিতেই মঠমন্দিরের শহর নবদ্বীপে মিষ্টির চাহিদা তুঙ্গে। শ’দেড়েক মিষ্টির দোকানই তার প্রমাণ।
কিন্তু পিঠেপুলির মতো মা-ঠাকুমার হাতের খাবার প্রথম দোকানে বিক্রির কথা উঠলেই প্রয়াত মিষ্টান্ন শিল্পী শিবু সেনকে স্মরণ করতে হয়। কয়েক দশক আগেই তিনি মানুষকে ভাজাপিঠে থেকে পাটিসাপটা, তালের বড়া থেকে মালপোয়া, শীতের রাতে নলেন গুড়ের পায়েস সবই খাইয়েছেন তাঁর দোকানে। মানুষ অবাক হয়েছে, লাইন দিয়েছে এবং কিনে খেয়েছে।
ক্রেতারা বলছেন “সন্দেশ, রসগোল্লা, চমচম তো রোজ পাবো। কিন্তু শীতকাল চলে গেলে কি পিঠেপুলি পাবো?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy