Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

এনআরএস তদন্তে ধীরে চলার নির্দেশ দলেরই

রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার। পাঁচ দিনের মধ্যেও নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হস্টেলের আবাসিকদের নামের তালিকা হাতে পায়নি পুলিশ। কারণ জিজ্ঞেস করলেই কলেজ-কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ পরস্পরের উপর দায় চাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু নিহতের পরিবার ও প্রশাসনের অন্দরে একাংশের দাবি, শাসক দলের চাপের মুখেই গতি পাচ্ছে না তদন্ত। এবং এর পিছনে তৃণমূলের এক বিধায়ক-চিকিৎসকের নাম উঠে আসছে।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন আরজিনা বেগম। এন্টালি থানায় ঢোকার মুখে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন আরজিনা বেগম। এন্টালি থানায় ঢোকার মুখে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২২
Share: Save:

রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার। পাঁচ দিনের মধ্যেও নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হস্টেলের আবাসিকদের নামের তালিকা হাতে পায়নি পুলিশ। কারণ জিজ্ঞেস করলেই কলেজ-কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ পরস্পরের উপর দায় চাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু নিহতের পরিবার ও প্রশাসনের অন্দরে একাংশের দাবি, শাসক দলের চাপের মুখেই গতি পাচ্ছে না তদন্ত। এবং এর পিছনে তৃণমূলের এক বিধায়ক-চিকিৎসকের নাম উঠে আসছে।

এনআরএসের ছাত্র ইউনিয়ন এখন তৃণমূলের দখলে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ হবু-চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেফতার করলে দলের প্রতিপত্তিতে আঁচ লাগতে পারে। স্বাস্থ্য দফতরের বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, পরিস্থিতি যাতে দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, তার জন্যই কলেজ-কর্তৃপক্ষকে তদন্তের ব্যাপারে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিতে বলা হয়েছে। ফলে বারবারই হাসপাতালে গিয়েও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে পুলিশকে। গোটা প্রক্রিয়ার পিছনে ওই বিধায়কই কলকাঠি নাড়ছেন বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর।

কে তিনি?

এ রাজ্যে চিকিৎসা জগতে তিনিই শাসক দলের একচ্ছত্র ক্ষমতাধারী। তৃণমূলের এক চিকিৎসক নেতার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে স্বাস্থ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু সরকারি চিকিৎসক এবং হাসপাতালগুলি চালান এক চিকিৎসক বিধায়ক। তিনি একাধারে তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেলের প্রধান, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি, স্বাস্থ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিষদীয় সচিব। নাম নির্মল মাজি।” এখানেই শেষ নয়। নির্মল মাজি বিধানসভায় স্বাস্থ্যবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তৃণমূল প্রভাবিত প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও তিনিই।


এনআরএস হস্টেলে ছাত্রদের পরিচয়পত্র দেখছে পুলিশ।—নিজস্ব চিত্র।

তবে নির্মলবাবুর আসল পরিচয়, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী। নির্মল তাঁর ক্ষমতা বিলক্ষণ জানেন। তাই এর আগে প্রকাশ্যেই তৃণমূল-বিরোধী চিকিৎসকদের ‘জ্যান্ত কুশপুতুল’ পোড়ানোর ডাক দিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। যে কোনও কলেজে গিয়ে সেখানকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। যখন-তখন কলেজের ছাত্রদের সামনে ঘোষণা করে থাকেন, তিনিই ‘মুশকিল আসান’। নির্মল নিজেই দাবি করেন, রাজ্যের সমস্ত ডাক্তারের বদলি হয় তাঁর নির্দেশে। স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তারাও তাঁকে ঘাঁটান না। তৃণমূলের এক চিকিৎসক নেতা পরিহাস করে মন্তব্য করেছেন, “দলে কাজের চাপ এতটাই যে নির্মল এমবিবিএস-এর বেশি এগোতে পারেননি। কিন্তু সামলাচ্ছেন ডবল এফআরসিএস-দেরও।”

পরিবর্তনের পরে এ রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে নকশালপন্থী, এসএফআই-এর দাপট হটিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পতাকা তোলার দায়িত্ব নির্মলের হাতেই দিয়েছিলেন মমতা। নির্মল সে কাজে ‘সফল’। এখন স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারাও তাঁর নির্দেশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “দলে কলকাতা পুলিশ যেমন মূলত ববিদা (পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম) দেখেন, স্বাস্থ্য দফতরের ভার নির্মলের হাতে দিয়েই দিদি নিশ্চিন্ত।” ওই নেতা-সহ দলের অনেকেই এ কথাও মানছেন যে, এনআরএস-এর ছাত্রদের মন পেতেই আবাসিকদের আড়াল করা হচ্ছে পুলিশের কাছ থেকে। তাঁদের দাবি, নির্মলবাবুর পরামর্শ অনুযায়ীই সব কিছু হচ্ছে। যাতে পরবর্তী কালে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র নির্বাচনে নিরঙ্কুশ থাকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ।

প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকেই যে নীলরতন-তদন্তে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রেরও। তিনি বলেন, “এনআরএস কলেজ কোনও স্বশাসিত অঞ্চল নয় যে সেখানে দেশের আইন খাটবে না। প্রশাসনের শীর্ষস্তর থেকে চাওয়া হচ্ছে না বলেই তদন্ত এগোচ্ছে না।” প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া সরাসরি নির্মল মাজির নাম না করলেও কারও হস্তক্ষেপেই তদন্ত আটকে থাকার অভিযোগ তুলেছেন।

নির্মল নিজে অবশ্য এই অভিযোগ মানছেন না। তাঁর কথায়, “সবার আগে আমিই এই ঘটনাকে পৈশাচিক, বর্বরোচিত বলে সমালোচনা করেছিলাম। কঠিন শাস্তি চেয়েছিলাম। আমি রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে ওই সব হবু চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ার পক্ষপাতী।” নির্মলের দাবি, “পুলিশ নিজেদের মতো করে তদন্ত করছে। প্রশাসনও চুপ করে বসে নেই। স্বাস্থ্য ভবন থেকে সাত সদস্যের দল গিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা হবেই।”

তা হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন হস্টেলবাসী ছাত্রদের তালিকা পুলিশকে দেননি? সবাসরি জবাব এড়িয়ে নির্মলবাবু বলেন, “দেখছি তালিকা কেন দেওয়া হচ্ছে না।” তার পরেই ফোনে কারও উদ্দেশে বলেন, “মঞ্জুদি-কে (নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়) বল, অবিলম্বে ছাত্রদের নাম-ঠিকানার তালিকা পুলিশকে দিতে। পুলিশের তদন্তে অসুবিধা হচ্ছে।” কাকে নির্দেশ দিলেন, তা অবশ্য জানা যায়নি।

নির্মলের ফোন সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার সন্ধেতেও কিন্তু ছাত্রদের নামের তালিকা পায়নি পুলিশ। লালবাজার জানাচ্ছে, রবিবার থেকে বারবার কলেজ-কর্তৃপক্ষের কাছে হস্টেলের বাসিন্দাদের নাম-ঠিকানার তালিকা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তা দেননি কলেজ-কর্তৃপক্ষ। কেন তাঁরা ওই তালিকা দিচ্ছেন না? কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “পুলিশ এ দিনই ওই তালিকা চেয়েছে। কিন্তু কারও ঠিকানা বা ফোন নম্বর চায়নি। আমরা তালিকা তৈরি করছি, শুক্রবার তা পুলিশকে দেওয়া হবে।” অথচ বুধবারেও তিনি ঠিক একই রকম ভাবে দাবি করেছিলেন, পুলিশ ওই দিনই তাঁর কাছে তালিকা চেয়েছে।

লালবাজারে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার ক্রাইম পল্লবকান্তি ঘোষ কিন্তু এ দিনও বলেন, “রবিবার ঘটনার দিনই এন্টালি থানা কলেজ-কর্তৃপক্ষের কাছে হস্টেলের আবাসিকদের নামের তালিকা চেয়েছিল। তা সত্ত্বেও কলেজ তা দিচ্ছে না দেখে বুধবার ফের আবাসিকদের নাম-ঠিকানা চেয়েছি আমরা। কিন্তু সেই তালিকা মেলেনি।”

এমতাবস্থায় পুলিশ কী করবে? বৃহস্পতিবার হস্টেল থেকে ছয় জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লালবাজারে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। তাদের তিন জন রাজমিস্ত্রী। তিন জন ক্যান্টিন কর্মী। এদিন হস্টেলে গিয়ে কয়েক জন আবাসিকের সঙ্গে কথা বলে এসেছে পুলিশ। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের সন্ধান মেলেনি। এক পুলিশ-কর্তার মন্তব্য, “কলেজ নাম-ঠিকানা না দিলে ক্যান্টিন কর্মীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে যে সব তথ্য মিলবে, তা দিয়েই তদন্ত এগোবে।”

এ দিনই এফআইআর করতে থানায় এসেছিলেন নিহত কোরপান শা-র পরিবার। কোরপানের স্ত্রী আরজিনাও জেনেছেন, গত চার দিনে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করা দূরে থাক, অভিযুক্তদের নামের তালিকাই পায়নি। কেন পায়নি, তা অবশ্য জানেন না হাওড়ার উলুবেড়িয়ার ওই গৃহবধূ। আরজিনার মন্তব্য, “আমি এ সব বুঝি না। আমি শুধু দোষীদের শাস্তি চাই।” নিহতের খুড়তুতো ভাই রওশন অবশ্য বলেন, “মনে হচ্ছে রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। তা না হলে পুলিশ কাউকে ধরছে না কেন?”

চাপ যে রয়েছে, কলকাতায় আসার পথে তা অন্য ভাবেও টের পেয়েছেন আরজিনারা। উলুবেড়িয়ার বাণীতবলার বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার আগেই তাঁদের মোবাইল ফোনে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন কোরপানের প্রতিবেশী শাহ আলম। তিনি বলেন, “বেরনোর সময় মোবাইলে ফোন করে স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তি আমাকে বলেন, এফআইআর করলে ক্ষতিপূরণ পেতে সমস্যা হবে। তার চেয়ে বিষয়টি বসে মিটিয়ে নেওয়াই ভাল।” প্রভাবশালী ব্যক্তিটি কে, তা অবশ্য জানাতে চাননি শাহ আলম।

কোরপানের এক নিকটাত্মীয়ের অভিযোগ, “আমরা তৃণমূল পরিবার। কোরপান তৃণমূলের কর্মী ছিল। উলুবেড়িয়া উত্তরের বিধায়ক হাসপাতালের ব্যাপারগুলি দেখেন বলে জানি। কিন্তু তাঁকে তো পাশে পাচ্ছি না।” পাশ থেকে এক প্রতিবেশীর মন্তব্য, “শুনেছি ওঁর কথায় চিকিৎসকেরা ওঠেন-বসেন। কোরপান তো তাঁর পাশের বিধানসভা কেন্দ্রের, তাঁর দলেরই লোক। তার খুনিদের খুঁজে বের করতে উনি কেন এত উদাসীন, বুঝতে পারছি না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE