শুধু কবি ও অনুবাদক নন, এ প্রজন্মের কবি-লেখকেরা পৌলোমীকে মনে রাখবেন এক সার্থক সম্পাদক হিসেবে। —ফাইল চিত্র।
একসঙ্গে চারটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন অনায়াসে। তার পাশাপাশি লিখেছেন কবিতা। গল্প। গ্রন্থ সমালোচনা। ভ্রমণ। নিয়েছেন সাক্ষাৎকার। করেছেন অনুবাদ। শুধু সিরিয়াস উপন্যাসেরই নয়, অ্যাসটেরিক্সের মতো কমিক্সেরও। তবে পৌলোমী সেনগুপ্তকে বোধ হয় আগামিদিনের বাংলা সাহিত্য সবচেয়ে বেশি মনে রাখবে একের পর-এক নতুন প্রতিভার সন্ধানী হিসেবে। শুধু কবি-সাহিত্যিকই নয়, তিনি খুঁজে এনেছেন নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক এবং সম্পাদকদেরও।
বাংলা সাহিত্যের এতগুলো শাখায় বিচরণ করা পৌলোমী সেনগুপ্তর জীবনের প্রথম পর্ব কিন্তু কেটেছে বাংলার বাইরে বিহারের জামালপুরে। সেখানে নোত্র দাম অ্যাকাডেমিতে লেখাপড়া করেন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু জামালপুরে বাংলা বই পড়ার সুযোগ কোথায়? বাবা দেবাশিস সেনগুপ্তই মেয়েকে নিয়ে বসতেন। শুধু অ, আ, ক, খ-ই নয়, তিনি কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে গীতা এবং আরও অন্যান্য বই মেয়েকে পড়িয়েছিলেন। বাংলা এবং সংস্কৃত দু’টি ভাষাই তিনি বাবার কাছে শিখেছেন। এমনকি মেয়েকে লেখালিখিতে উৎসাহও দিয়েছিলেন। বাড়িতে আসত দেশ, আনন্দমেলার মতো পত্রিকা। সেই পত্রিকাও তৈরি করে দিচ্ছিল সাহিত্যের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ। বাবা আসানসোলে বদলি হওয়ায় তিনি চলে আসেন মালদায়, মামার বাড়িতে। বাবার অকালমৃত্যুর পরে সেখান থেকে কলকাতায়।
ভর্তি হন আলিপুর মাল্টিপারপাস গার্লস স্কুলে। সেই সময় থেকেই লেখালিখির প্রতি আগ্রহ আরও বেশি করে গড়ে উঠতে থাকে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার উদ্দেশে ভর্তি হন সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজে। তার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করেন। সেই সঙ্গে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ় থেকে ফরাসি ভাষাও শিখেছেন। পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারে তিনি ফরাসি এবং ইংরেজি পড়িয়েওছেন। কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত
হতে থাকে দেশ এবং অন্য পত্রপত্রিকায়। গত শতাব্দীর নয়ের দশকের প্রথম সারির কবি হিসেবে উঠে আসতে থাকেন তিনি। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পেনসিল খুকি’ যা পরের বছরই কৃত্তিবাস পুরস্কার পেয়েছিল।
অবশ্য তার আগেই তাঁর সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত। ১৯৯৪ সালে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ সংবাদপত্রে যোগ দেন। কিন্তু বছরখানেক চাকরি করার পর ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চলে যান সরকারি চাকরিতে। সেবার ডব্লিউবিসিএস-এ মেয়েদের মধ্যে তিনি প্রথম হন। সেখান থেকে ফিরে আবার ২০০১ সালে এসে যোগ দেন ছোটদের পত্রিকা আনন্দমেলায়। শুরু হয় তাঁর জীবনের মূল ইনিংস।
এর পর জন্ম হল উনিশ কুড়ি পত্রিকার। কিছু দিন বাদে উনিশ কুড়ি কেরিয়ার-ও প্রকাশ পেল। জন্মলগ্ন থেকেই তিনি ওই দুই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ধীরে-ধীরে দায়িত্ব বাড়তে থাকল। সানন্দা, আনন্দলোক পত্রিকারও সম্পাদনার দায়িত্ব সামলাতে হল তাঁকে। এক-একটি পত্রিকার ধরন এক-এক রকম। তবু তাঁর অধীনে কাজ করা সহ-সম্পাদকেরা দেখতেন কী অনায়াসে তিনি প্রতিটি পত্রিকার কাজ ভাগ করে নিতে পারতেন। হয়তো সানন্দার টিমের সঙ্গে মিটিং করেছেন। তার পরেই এসে বসে গিয়েছেন আনন্দমেলার সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে পত্রিকার পরবর্তী বিষয় সম্পর্কে আলোচনায়।
এরই মধ্যে সারদা মঠের প্রব্রাজিকা শ্রদ্ধাপ্রাণামাতাজির কাছে দীক্ষাও নিয়েছিলেন।
এই সব কাজ করতে-করতেই পৌলোমী সেনগুপ্ত গড়ে তুলতে লাগলেন নতুন লেখক গোষ্ঠী। লেখার স্বকীয়তাকে বিশেষ জোর দিতেন। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। বুঝতেন, কোন পত্রিকায় কোন ধরনের লেখা পাঠকদের ভাল লাগবে। আর বিশেষ উৎসাহ দিতেন বিদেশি সাহিত্য পড়ার ব্যাপারে।
এত কাজের দায়িত্ব সামলানোর ফাঁকে-ফাঁকে কিন্তু তাঁর কলম সচল ছিল। খানিক বিরতি দিয়ে হলেও প্রকাশ পাচ্ছিল কাব্যগ্রন্থগুলো। আমরা আজ রুমাল চোর (২০০০), উল্কি (২০০৪), মেট্রোয় বৃষ্টি (২০১২)। কাব্যগ্রন্থ সংকলনও রয়েছে ‘মুঠোর মাপ উপচে যেন পড়ে’। শুধু তাই নয়, মূল ফরাসি ভাষা থেকে তিনি অনুবাদও করেছেন অ্যাসটেরিক্সের কমিক্সের। ঝুম্পা লাহিড়ীর দু’টি বই, সমনামী (দ্য নেমসেক) এবং নাবাল জমি (দ্য লোল্যান্ড)-এর অনুবাদও তাঁরই করা। ইচ্ছে ছিল ইংরেজিতে একটা উপন্যাস লেখার।
পৌলোমী সেনগুপ্তকে যেমন বাংলা সাহিত্য মনে রাখবে একজন শক্তিশালী কবি হিসেবে, তেমনই মনে রাখবে বাংলা ভাষার একজন প্রধান সম্পাদক হিসেবেও। কারণ, বাংলা সম্পাদনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। আর রেখে গিয়েছেন এক ঝাঁক তরুণ সাংবাদিকদের। যাঁরা তাঁর পরম্পরা বহন করে নিয়ে চলেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy